
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ১০তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৭ আগস্ট বুধবার। ২০০৬ সালের আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বনানী গোরস্তানে মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। পুরনো ঢাকার মাহুতটুলিতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর জন্ম নেওয়া এই কবি জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কবি বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। তার জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে কবিতার সঙ্গে। পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠার কারণে নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ তুলে ধরেছিলেন কবিতায়।
ষাটের দশকের শুরুর দিকেই তার কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত হতে থাকে সাহিত্যের ভুবন। ‘ঊনিশশ’ ঊনপঞ্চাশ’ রচনার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে পদচিহ্ন আঁকেন কবিতার আঙিনায়। এটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। সূচনটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতা দিয়ে হলেও পরে দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন। পত্রপত্রিকায় লেখা তার চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্র ধরে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই বাংলা কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কবির নিমগ্ন অন্তর্গতবোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এ কাব্যগ্রন্থে। ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, আমি অনাহারী ইত্যাদি।
শামসুর রাহমান সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার রচনার মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উজ্জীবিত মানুষকে যুগিয়েছেন প্রেরণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তার দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়।
তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন কলমকে। রচনা করেন বহু অনবদ্য কবিতা। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ কবিতা। সত্তরের নভেম্বরে ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, তারও আগে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘গেরিলা’, ‘কাক’ ইত্যাদি কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে এ দেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন কবিতা ‘টেলেমেকাস’। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ ও ‘ইকারুসের আকাশ’। যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচনা করেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্যভাষ্যকার। একইসঙ্গে কবিতার জমিনে তিনি পরিষ্ফূটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, ভালবাসাসহ নানা বিষয়ের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। নগর জীবনের প্রতি ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তার কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে গদ্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর’।
এর বাইরে সাংবাদিকতা পেশায় দীর্ঘসময় কাটান তিনি। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে মর্নিং নিউজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। এরপর দৈনিক বাংলাসহ বহু জনপ্রিয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেন। শামসুর রাহমান স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি দেয়া হয় তাকে। নানা আয়োজনে আজ কবিকে স্মরণ করবে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
কবির ১০ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় কবিতা পরিষদ, শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদ, কবি শামসুর রাহমান ফাউন্ডেশন ও কবির পরিবারের পক্ষ থেকে কবির বনানীস্থ সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। বিকেল ৩টায় কবি শামসুর রাহমান ফাউন্ডেশন কবির গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী কলিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক কবি-সাহিত্যিক মিলনমেলার আয়োজন করেছে। আলোচনা, গান, আবৃত্তি ও নিবেদিত কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে কবি শামসুর রাহমানকে স্মরণ করবে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ।
শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবাবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার (১৭ আগস্ট) বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সেমিনার কক্ষে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগের সম্মানীয় সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কবি কামাল চৌধুরী, কবি মোহাম্মদ সাদিক, কবি আসাদ মান্নান, বেগম আখতার কামাল, কবি মাহবুবুল হক শাকিল, কবি সোহরাব হোসেন, কবির পুত্রবধূ টিয়া রাহমান ও বিটিভি`র মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ।
আয়োজক সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মাসুদ পথিক দ্য রিপোর্টকে জানান, অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিতে কবি নির্মলেন্দু গুণকে সংবর্ধনা প্রদান করবে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমান ও নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে আবৃত্তি ও শামসুর রাহমানকে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাড়াও স্মৃতি অনুভবের পাশাপাশি চাষার পাল ব্যান্ড দল গান পরিবেশন করবে।
এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠন কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাবে।
শেয়ার বিজনেস24.কম