ঢাকা   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতায় নাকাল পৌরবাসী

সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতায় নাকাল পৌরবাসী

অব্যাহত বৃষ্টিপাতে সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়েছে। পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলবদ্ধতা। রোববার রাত ১২টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়ার সাথে তীব্র বৃষ্টিপাত হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ২৫ টি এলাকা পানিবন্দি থাকায় নাকাল হয়ে পড়েছে পৌরবাসী। ঘরের ভিতরে হাঁটু জল কোমর পানি থাকায় সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। খাবার পানির তীব্র সংকটের পাশাপাশি হাঁটু জল কোমর জল ভেঙে মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করছে। পৌরসভার সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে এলাকাবাসী। আর এ কারণে পৌরসভার টানা দুই মেয়াদের মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতির অনিয়ম-দুর্নীতিকে দুষছেন পৌরবাসী।

অপরদিকে হাঁটুর সমান পানিতে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলো পানিবন্দি রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো যাতায়াত করতে পারছে না। বেশি বিপাকে পড়েছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড, পুলিশ লাইন্সসহ সাতক্ষীরা সদর, তালা, কলারোয়া, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা গত ১৫ দিন  আগে প্লাবিত হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টার তীব্র বৃষ্টিপাতে প্লাবিত এলাকার পানি এক থেকে দুই ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে আমন বীজতলা, আউশ ধান, সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মৎস্য ঘের। 
তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেননি মৎস্য ও কৃষি বিভাগ। এছাড়া  শহর ও আশপাশের গ্রামের শতাধিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে আছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে । জুলাই মাস জুড়ে বৃষ্টিপাত হাউয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন তিনি।
 
এদিকে সবচেয়ে পানিবন্দি অবস্থায় নাকাল হয়ে পড়েছে সাতক্ষীরার পৌরবাসী।সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, শহরের কামালনগর, ইটাগাছা, পলাশপোলের মধুমল্লারডাংগি, মেহেদীবাগ, পুলিশ লাইন স্কুল মোড়, রসুলপুর, বদ্দিপুর কলোনি, রইচপুর, মধ্য কাটিয়া, রথখোলা, রাজারবাগান, ক্লাব মোড়, পুরাতন সাতক্ষীরা, গদাইবিল, মাঠপাড়া, কাটিয়া সরকার পাড়া, পার-মাছখোলা ও পুরাতন সাতক্ষীরা সহ ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভার নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে আছে। 

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা পৌরসভার ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা। পৌরসভার গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থার জন্য টানা দুই মেয়াদের সাবেক মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতিকে দুষছেন এলাকাবাসী। 

পৌরসভার মধুমল্লারডাংগিতে বিশ দিন ধরে বসত বাড়িতে হাঁটুপানি আবার কোথাও কোথাও কোমর পানি জমে আছে। সেখানে প্রায় ২০০ ঘর পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। প্রতিনিয়ত সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘর ছাড়ছেন এলাকাবাসী।

ইটাগাছা বিলপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হাসান বলেন, ঘের মালিকরা বিলে পানি আটকে রেখেছে। বাইপাসের স্লুইস গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি খাল দিয়ে নদীতে নামতে পারছে না। ফলে ঘরে-পথে সবখানে পানি।

বদ্দিপুর কলোনির গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, ১০ বছর ধরে এমন হয়, কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এবার রান্না ঘরে পানি ঢুকে হাড়ি-পাতিল নষ্ট। পোকা-মাকড় ঘওে ঢোকায় রাতে ঘুমাতে পারছি না। সন্তানদের নিয়ে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্য তরে নিরাপদ জায়গায় থাকতে হচ্ছে।

এদিকে টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ লাইন্স। পুলিশ লাইন্সের প্রবেশ গেইট হতে শুরু করে রিজার্ভ অফিসের সামনের রাস্তা, ব্যারাক সংলগ্ন রাস্তা, অস্ত্রাগার আঙিনা, রেশন স্টোরের আঙিনায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।  সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার অফিস জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। পুলিশ লাইন্স  ও স্কুল ক্যাম্পাসে হাঁটু পানি জমে আছে। 

পাটকেলঘাটা আমিরুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হারুনা রশিদ ডিগ্রী কলেজ, কালীগঞ্জের মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ স্কুল, বদ্দিপুর প্রাইমারি স্কুলসহ বহু প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ভেলা, বাঁশ বা জুতা হাতে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। 

কালীগঞ্জের মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত বৈদ্য বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে বিদ্যালয়ের আঙিনায় হাঁটাচলা করাই দায়। শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।

অভিভাবকরাও হতাশার মধ্যে রয়েছে। তারা বলছে এই দুর্যোগে সন্তানদের স্কুলে পাঠাবো কিভাবে? শিশুরা ঠান্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে ।

জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে শহরতলির উত্তর কাটিয়া, ইটাগাছা, কুখরালি, ব্রহ্মরাজপুর, ঝাউডাঙ্গা, ফিংড়ি, আগরদাঁড়ি, বাঁকাল, তালতলা এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলো।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শোয়াইব আহমাদ জানান, অতি বৃষ্টিপাতের কারণে গত বছরের ন্যায় এ বছরও সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য  বিলের নেট পাটা অপসারণ করা হয়েছে। অনেক স্থানে ঘের মালিকদের দেওয়া অবৈধ নেটপাটার কারণে পানি ঠিকমত সরতে পারছে না। এর আগেই গতবছর জলবদ্ধতা নিরসনে সাতক্ষীরার খালগুলো খনন করা হয়েছে। শহরের প্রাণ সাহেরের খাল, বেদনা নদী ও কুঞ্জুর স্লুইচগেট খুলে দেওয়া হয়েছে। পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে একটু সময় লাগবে।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মনির হোসেন জানান,  টানা বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন বীজতলা, আউশ ধান ও সবজির ক্ষেত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন বীজতলা, বরবটি, সিম, শসাসহ বিভিন্ন সবজির ক্ষেত ।

জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, শুধু উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে জলাবদ্ধতার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য স্থানীয়দের অংশগ্রহণে বাঁধ নির্মাণসহ সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।