ঢাকা   বুধবার ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২

আষাঢ়ে চমৎকার এক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মিলন 

বিনোদন

ডেইজী মউদুদ    

প্রকাশিত: ১২:২৯, ৯ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১২:৩৫, ৯ জুলাই ২০২৫

আষাঢ়ে চমৎকার এক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মিলন 

গত ৪ জুলাই, ২০ আষাঢ়। মানে বিদ্যাপতির 'এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর' ভরা বর্ষা। আকাশ ঘন ঘোর কালো মেঘে ঢাকা। আর বিশিষ্ট শিল্পী শীলা মোমেন যখন নিবেদিত গলায় গাইছিলেন 'আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে.. 'তখন কিন্তু আকাশ ভেঙে তুমুল বৃষ্টি প্রকৃতিতে। যদিও বা সেদিন একটি একেবারেই অনাড়ম্বর একদম ঘরোয়া অথচ সরস আর প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ছিল, কিন্তু কবি লেখক, গায়ক গায়িকা, গবেষক, শিক্ষক, আলোকচিত্রী, চারুশিল্পী, সাংবাদিসহ রকমারি নান্দনিক পেশাজীবীর প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান একেবারেই ব্যতিক্রমী আমেজে অনবদ্য হয়ে উঠে। আর সব চেয়ে মজার বিষয় হলো উপস্থিত সকলেই কিন্তু এক পরিবারের সদস্য। চট্টগ্রামের আলম পরিবার এক নামেই যার পরিচিতি।

এই পরিবারের ভিত গড়েছিলেন মৌলভী নসিহ উদ্দীন। যিনি ছিলেন একজন আধুনিক ও উদার মানবতাবাদী পুরুষ। তিনি  অষ্টাদশ শতকে হাটহাজারীর প্রত্যন্ত অঞ্চল ফতেপুর গ্রাম থেকে এসে সন্তানদের ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসে ফতেয়াবাদের ছড়ারকূলেএসে বসত গড়েন। ফলে উনার চার পুত্র শামস উল আলম, মাহবুব উল আলম, দিদারুল আলম এবং ওহীদুল আলম ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কূপ মুণ্ডকতার খোলস থেকে বের হয়ে এসে একটি আধুনিক, উদার মানবতাবাদী এবং শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ধ্যান জ্ঞান সমৃদ্ধ পারিবারিক বলয় নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। একটি অনগ্রসর মুসলিম সমাজে তৎকালীন সময়ে নি:সন্দেহে এই পরিবারের কর্মযজ্ঞ এক বিরল ঘটনা।

আর এর  প্রধান কারিগর ছিলেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক মাহবুবউল আলম।তার মেধা প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব এবং সঠিক দিকনির্দেশনায়  ইতিহাসের খাতায় এই পরিবার চিহ্নিত হয় সাহিত্য পরিবার তথা আলম পরিবার হিসেবে। একটি সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার গল্প লিখতে গিয়ে শুধুমাত্র এই প্রজন্মের পাঠক আর লেখকদেরকে পরিবারের শেকড় আর ঐতিহ্য জানাতেই খানিকটা পেছনে গিয়ে উনাদের পরিচিতি দিলাম। সাংস্কৃতিক এই অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ড.মাফরুহা  আলম পূর্বা। তার পিতা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহমুদুল আলম। আর মাতা লেখক ও শিক্ষক নাজমাতুল আলম। পূর্বা অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী। প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে সে একেবারেই সংক্ষিপ্ত সফরে দেশে এসেই সেদিনের এই চমৎকার সন্ধ্যাটি পরিবারকে উপহার দিয়ে সবাইকে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়।সমাজের এই ক্রান্তিকালে যেখানে সবাই দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকারে লিপ্ত, সেখানে যেনো এক ঝলক আনন্দ আর নান্দনিকতা এসে সবাইকে আলোকিত করে দিল। এখানে বাইরের কোন গানের শিল্পী বক্তা কিংবা উপস্থাপিকার প্রয়োজন নেই। সবই আছেন। কেউ প্রাক্তন বেতারশিল্পী, কেউ সেতার বাদক। কেউ হারমোনিয়াম, কেউ তবলায়, কেউ নাচে, কেউ অভিনয়ে অংশ নেন। কবিতা, গান ছবি আকা অর্থাৎ (বুলি তুলি তাণ  'নামে একটি সংগঠন ছিল, যেটি শিল্পী সবিহ উল আলম গড়ে ছিলেন। রাংগা তুলির আঁচড় নামেও সংগঠন ছিল উনাদের) তাল, তুলি, সুর লয় সবারই আছে।

এজন্য আয়োজক পূর্বার উপস্থাপনায় সমবেত সংগীত ' আগুনের পরশমনি ' দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।এরপরে আবৃত্তি, আবার গান, আবার কথানালা আর স্মৃতিচারণে বিকাল ৪ টা থেকে কখন যে রাত ৮/৯ টা বেজে গেলো টেরই পেলাম না। শুরুতেই পরিবারের প্রয়াতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন ক রা হয়। পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য মনিরাতুল আলম লাঠি ভর করে এসেও খুশি। সারল্য আর প্রাণবন্ত এই হাসি থেকে যেনো রাশি রাশি মুক্তোদানা ঝরে পড়ছিল! চিন্তা করতে পারেন, উনার বয়স ৯০। আরেকজন বেতার শিল্পী মদিনাতুল আলম, এখন বয়স আর রোগের ভার নিয়েও হাজির, একটি  ছোট্ট পুতুলের মতো চুপ করেই বসেছিলেন। উপভোগ করেছিলেন এই আনন্দ আড্ডা।

অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের স্মৃতিচারণ আর শীলা মোমেনের গান। আবুল মোমেন স্মৃতিচারণে পরিবারের সদস্যদের সাথে তার নানান মজার মজার স্মৃতির কথা বলেন। উনি এখন নিজেই প্রবীণের দলে। তার খেলার সাথীরাও একই দলে। তিনি পরিবারের ভিত নির্মাণের কথা বলতে গিয়ে চার আলম ভাতৃবর্গের কর্ম ও জীবন দর্শন, উদার মানবিকতা, জীবন ও জগতের অপরিমেয় জীবনরস এবং সুধাকে তারা কিভাবে আস্বাদন করেছিলেন, ভোগ বিলাসে না গিয়ে ও প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে লালন করে সাহিত্য পাঠ আর চর্চা করে সাহিত্য আর সংস্কৃতি থেকে যে জীবনকে বহুমাত্রিক চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ করা যায়, তা অত্যন্ত সাবলীল আর সরস কথামালায় তুলে ধরেছেন।

অগ্রজদের মাঝে তিনি যে জীবনরস আর অমিয় সুধা দেখেছিলেন, সেটিই যেনো এই প্রজন্ম ধারণ করে তা চর্চা করে, লালন করে, তিনি সে অনুরোধ জানান। উপস্থিতির প্রত্যেকেই কোন না কোন আঙ্গিকে পারদর্শী। সময়ের স্বল্পতায় সবাইকে মঞ্চে ডাকার সুযোগ ছিলনা। কিছু কিছু কথামালা আর একক গান, কোরাস গানে অনুষ্ঠান ছিল প্রাণবন্ত। অনেক দিন পর একে অপরকে পেয়ে খুশিতে আটখানা সকলেই। তবে মজার ব্যাপার হলো উপস্থাপিকা এই পরিবারের বধুদেরকে তাদের অনুভূতি জানানোর সুযোগ দিয়ে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত সূচনা করেন। দীর্ঘদিন পর পরিবারে এমন আয়োজনে প্রবীণ সদস্যরা তো বটেই নবীন সদস্যরাও ছিলেন উল্লসিত।