facebook twitter You Tube rss bangla fonts
Walton

ভয়াবহ মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদন নিয়েছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ


৩১ অক্টোবর ২০২২ সোমবার, ০৮:০৩  পিএম

নজরুল ইসলাম

শেয়ার বিজনেস24.কম


ভয়াবহ মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদন নিয়েছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমতি নিতে সম্পদমূল্য ১৪ গুণ বেশি দেখিয়েছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। দরপতনের এই নিম্নমুখী বাজারে শেয়ার প্রতি ৪০ টাকা প্রিমিয়াম নেবে প্রতিষ্ঠানটি। আর শুরুতেই বিনিয়োগকারীদের পকেট কেটে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে প্রিমিয়াম বেশি পেতে আর্থিক প্রতিবেদন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে ওষুধ খাতের এই পারিবারিক প্রতিষ্ঠানটি।

আর এই অনৈতিক কাজে কোম্পানিটিকে সহায়তা করেছে ইস্যু ম্যানেজার শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ও দায় এড়াতে পারে না অডিট প্রতিষ্ঠান আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোং।

এছাড়া ২০১৯ সালে ৯৩ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এই কোম্পানিটি হঠাৎ করে ২০২১ সালে আলাদিনের চেরাগের মতো ৮৭ কোটি টাকা মূলধনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অর্থাৎ দুই বছরে এশিয়াটিক ল্যাবটরিজের মূলধন বেড়ে যায় ৮৭ গুণ। কোম্পানিটির প্রসপেক্টাসে এই ক্যাপিটাল রেইজের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

এশিয়াটিক ল্যাবটরিজের প্রসপেক্টাসের ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর যে খতিয়ান দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায় ১৯৭০ সালে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ১ হাজার টাকা। ১৯৯৮ সালে পরিশোধিত মূলধন বেড়ে হয় ৭০ হাজার ৩৫০ টাকা। অর্থাৎ ২৮ বছর কোম্পানিটি ১০০০ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে চলে। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। এরপরই আসল ভেলকি দেখায় প্রতিষ্ঠানটি। আইপিও অনুমোদন পেতে ২০১৯ সালে পরিশোধিত মূলধন ৮০ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার ৬৫০ টাকা নগদ ডিপোজিট ও সাড়ে ৬ কোটি টাকার বোনাস শেয়ার দিয়ে হয়ে যায় ৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার কোম্পানি।

কোম্পানির প্রোসপেক্টাসের গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঠাকুরপাড়া মৌজায় ৫৪২ ডেসিমেল জমি সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে ২৫০ ডেসিমেল জমির দাম দেখানো হয় ৫ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে কেনা ১৩২ ডেসিমেল জমির দাম দেখানো হয় ২ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। একই বছরের মার্চ মাসে কেনা হয় ৯৪ ডেসিমেল ও মে মাসে কেনা হয় ৬৬ ডেসিমেল জমি। যার দাম যথাক্রমে ২ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও এক কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।

 

গাজীপুর টঙ্গীর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এশিয়াটিক ল্যাবটরিজ ওই সব সম্পত্তির দাম কাঠা প্রতি সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ গুণ বেশি দেখিয়েছে। কালিয়াকৈরে জমির দাম মোট দেখানো হয় ১১ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। জমির প্রকৃত দাম থেকে যা বেশি। অর্থাৎ কাঠা যেখানে হওয়ার কথা ছিল ৯০ হাজার টাকা সেখানে দেখানো হয় সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দেওয়া মূল্য তালিকায় দেখা যায়, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঠাকুরপাড়া মৌজায় প্রতি ডেসিমেল জমির সর্বোচ্চ দাম ২০১৬ সালে ছিল ৪৫ হাজার ৬৭৬ টাকা।

একইভাবে টঙ্গীর মাছিমপুর ও রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার জমির মূল্যও কয়েগুণ বেশি দেখিয়েছে। ২০১৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর মাছিমপুরে দুই দফায় ৯৩.৪ ডেসিমেল জমি কিনে প্রতিষ্ঠানটি। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দেওয়া মূল্য তালিকায় দেখা যায়, গাজীপুরের টঙ্গীর মাছিমপুর মৌজায় প্রতি ডেসিমেল জমির সর্বোচ্চ দাম ২০১৬ সালে ছিল ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৩১৮ টাকা। এখানেও এশিয়াটিক ল্যাব জমির দাম বেশি দেখিয়েছে। দামের ব্যবধান প্রায় ১০ কোটি টাকা।

তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্রতি ডেসিমেল জায়গার দাম ৩৪ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা। সে হিসেবে ৩৩ ডেসিমেল জায়গার দাম হয় ১১ কোটি সাড়ে ২৩ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটি দেখিয়েছে সাড়ে ৩২ কোটি টাকা।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলতে ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের গত ১০ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিডিং হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের কাট অফ প্রাইস নির্ধারণ হয়েছে ৫০ টাকা। এখানেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণগ্রস্ত কোম্পানিটির শেয়ারমূল্য নিয়ে। কারণ সম্পদমূল্য অতিরঞ্জিত দেখানোর ফলে এর প্রিমিয়ামও বেশি পড়েছে।

আর্থিক হিসাবে সম্পদের দাম ১৪ গুন বেশি দেখানো ও অন্যান্য বিষয়ে এশিয়াটিক ল্যাবটরিজ লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি ইশতিয়াক আহমেদ সঠিক কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, আমাদের এই আর্থিক প্রতিবেদন দেখেই বিএসইসি এশিয়াটিক ল্যাবটরিজকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে।

এছাড়া সম্পদ বিবরনীতে ৩০ জুন ২০২১ সালে ইনভেন্টরিজ দেখানে হয়েছে ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৬ টাকা, ট্রেড অ্যান্ড আদার রিসিভ্যাবল ১৯ কোটি ২২ লাখ ২ হাজার ৫৩০ টাকা, এডভান্স ডিপোজিট অ্যান্ড প্রিপেমেন্ট ১০ কোটি ৯৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৬২ টাকা ও ক্যাশ অ্যান্ড ইক্যুইপমেন্ট বাবদ ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকা দেখিয়েছে।এশিয়াটিক ল্যাবটরিজ এ ধরনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদন নিয়ে থাকলে ইস্যু ম্যানাজার শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ও অডিটর দায়ী হবেন বলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, এর বেশি আমি মন্তব্য করতে পারব না।

এরই মধ্যে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের শেয়ার দরের নিলাম (বিডিং) শেষ হয়েছে। নিলাম শেষে শেয়ারটির কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে ৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ারপ্রতি ৪০ টাকা করে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম হিসেবে নেবে প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই ৫০ টাকার ৩০% ডিসকাউন্ট অর্থাৎ ৩৫ টাকা অথবা ২০ টাকা, যেটি কম সে মূল্যে শেয়ার পাবেন। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের প্রতিটি শেয়ার ২০ টাকা করে কিনতে পারবেন। গত ১০ অক্টোবর বিকাল ৩টায় থেকে একটানা ১৩ অক্টোবর বিকাল ৩টা পর্যন্ত কোম্পানিটির বিডিং অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটিকে গত ৩১ আগস্ট বিডিংয়ের অনুমতি দেয়। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ৯৫ কোটি টাকা তুলবে।

১৯৭০ সালে নিবন্ধন পায় এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ। ১৯৯৮ সাল থেকে তারা কাজ শুরু করে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনির আহমেদ, আর চেয়ারম্যান তাহমিনা বেগম। আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিএসইসির দেয়া শর্ত অনুসারে, তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটি কোনো ধরনের লভ্যাংশ ঘোষণা, অনুমোদন বা বিতরণ করতে পারবে না।

 

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

শেয়ারবাজার -এর সর্বশেষ