facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৭ জুলাই শনিবার, ২০২৪

Walton

ভাইরাল হেপাটাইটিস:চিকিৎসা ও প্রতিকার


১৪ নভেম্বর ২০১৬ সোমবার, ১০:১১  পিএম

অধ্যাপক মবিন খান

শেয়ার বিজনেস24.কম


ভাইরাল হেপাটাইটিস:চিকিৎসা ও প্রতিকার

ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। ম্যালেরিয়া, যক্ষা এবং এইচআইভি-এইডস-এর ন্যায় ভাইরাল হেপাটাইটিসও প্রতি বছর অনেক মানুষের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর জন্য দায়ী। বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। সময়ের প্রয়োজনে এই দেশের মানুষ হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে হেপাটাইটিস জনিত লিভার প্রদাহের চিকিত্সায় বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে।
 
হেপাটাইটিস ভাইরাস কি
প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস আছে যা মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তন্মধ্যে কতগুলো ভাইরাস সুনির্দিষ্টভাবে মানবদেহের লিভার কোষকে আক্রমণ এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। এ কারণে এই ভাইরাসগুলোকে হেপাটাইটিস ভাইরাস বলা হয়। প্রধানত যে ভাইরাসগুলো দিয়ে লিভারের প্রদাহ হয় সেগুলো হলো:হেপাটাইটিস ‘এ’, হেপাটাইটিস ‘বি’, হেপাটাইটিস ‘সি’, হেপাটাইটিস ‘ডি’, এবং হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। তন্মধ্যে ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাস সাধারণত স্বল্প মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। হেপাটাইটিস ‘ডি’ ভাইরাস পৃথকভাবে লিভার প্রদাহ করতে পারে না। ‘ডি’ ভাইরাস ‘বি’ ভাইরাসের আবরণে লিভারে প্রবেশ করে।
 
হেপাটাইটিস ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়
হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। উক্ত ভাইরাসদ্বয়ের অন্যতম উত্স হলো- রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে বিক্রয়কৃত শরবত, ফলের রস এবং অন্যান্য পানীয় এবং খোলা অবস্থায় রেখে দেয়া খাবার যেগুলোতে মাছি বসে দূষিত করে ফেলেছে। এছাড়াও দৈনন্দিন রান্নার কাজে ব্যবহূত পানি ফুটিয়ে ব্যবহার না করলে ও বাজার থেকে কেনা শাক-সবজি ও ফলমূল ভালোমত না ধুয়ে নিলে হেপাটাইটিস ‘এ’ বা হেপাটাইটিস ‘ই’ হতে পারে। বাংলাদেশে বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন জায়গায় খাবার পানি সংকট দেখা দেয় এবং এ সময় হেপাটাইটিস ‘ই’ এর মহামারী দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। দূষিত রক্ত গ্রহণ, দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহার, নাপিত কর্তৃক ক্ষুরে দূষিত ব্লেড ব্যবহার, অপরিশোধিত যন্ত্রপাতি দিয়ে অস্ত্রোপ্রচার, আক্রান্ত মা থেকে শিশুতে এবং অনিরাপদ যৌনমিলনের মাধ্যমে ছড়ায়।
 
হেপাটাইটিস ভাইরাসের গঠন-
ভাইরাসের সাধারণত: গঠন হলো-এটির সারফেস তথা বাইরের দিকে একটি প্রোটিন নির্মিত ক্যাপসিড থাকে। কোন কোন ভাইরাসের ক্যাপসিডের বাইরে প্রোটিন, ফসফোলিপিড ও গ্লাইকোলিপিড নির্মিত আরেকটি আবরণী থাকে, যাকে বলে এনভেলোপ। ভাইরাসের ভিতরের অংশকে বলে কোর। কোর অংশে এক বা একাধিক প্রোটিন এবং ভাইরাসের জেনেটিক তথ্য ধারণকারী নিউক্লিয়িক এসিড থাকে। ভাইরাসের প্রকারভেদে উক্ত নিউক্লিয়িক এসিড আরএনএ বা ডিএনএ  হতে পারে।
 
হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে মানবদেহের প্রতিরক্ষা এবং লিভার প্রদাহ-
হেপাটাইটিস ভাইরাস লিভারে প্রবেশ করলে মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাসকে শরীর থেকে দূর করতে এবং মেরে ফেলতে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রিয়াশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘ইন্টারফেরন’ নামক অণু। শারীরিক এই প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত লিভার কোষের চারিদিকে বিভিন্ন প্রকারের শ্বেত রক্ত কণিকা জমা হতে থাকে এবং বিভিন্ন অণু নিঃসরণ করতে থাকে। শারীরিক এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় ‘ইনফ্লেমেশন’ বা প্রদাহ। যেহেতু ভাইরাস লিভারে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে সেহেতু উক্ত প্রদাহের কারণে আক্রান্ত লিভার কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লিভারের ভিতর বিলিরুবিন নামক অণু প্রক্রিয়াজাত হয়, যা লিভার প্রদাহের সময় রক্তে বেরিয়ে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে লিভার প্রদাহে আক্রান্ত ব্যক্তির চোখ, জিহবা, ত্বক এবং প্রস্রাব হলুদ হয়। যাকে আমরা জন্ডিস বলে থাকি। এছাড়াও এ প্রক্রিয়ায় লিভার কোষের ভিতর ক্রিয়াশীল এনজাইম এএলটি এবং এএসটি রক্তে বেরিয়ে আসে। লিভার কতটুকু আক্রান্ত হল তা রক্তের উক্ত বিলিরুবিন ও এনজাইমদ্বয় পরিমাপ করার মাধ্যমে বের করা যায়। আমরা আগেই জেনেছি, হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাস স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। এই ভাইরাসদ্বয় লিভারে প্রবেশের পর খুব দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও খুব দ্রুত কাজ শুরু করে। এ ভাইরাসদ্বয়ের সাথে লড়াই করতে শরীরে তৈরী ইন্টারফেরন ও অন্যান্য অনুই যথেষ্ট। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি পর্যাপ্ত বিশ্বাম পেলে এবং স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করলে সাধারণত: দুই সপ্তাহের মধ্যে একা একাই সুস্থ হয়ে উঠে। অন্যদিকে, হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাস লিভার কোষে প্রবেশের পর অনেক দিন অবস্থান করতে থাকে এবং তুষের আগুনের মত লিভারে প্রদাহ করতে করতে লিভার সিরোসিস নামক জটিলতার দিকে নিয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে শরীরের উক্ত ভাইরাসদ্বয়ের বিপরীতে ইনফ্লামেশন সৃষ্টি করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তারা ভাইরাস দূর করতে সফলও হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর ১ থেকে ৪ মাসের মধ্যে ভাইরাস মুক্ত হতে পারে। তবে শরীরে এরা ৬ মাসের বেশি থেকে গেলে দীর্ঘ মেয়াদী রোগে পরিণত হয়েছে ধরা হয়। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ৯০ শতাংশ নবজাতক, ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু যাদের বয়স এক থেকে পাঁচ বছর এবং ৬ থেকে ১০ শতাংশ ব্যক্তি যাদের বয়স পাঁচের উপরে দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যক্তির লিভার প্রদাহ ১ থেকে ৩ মাসের মধ্যে ভাল হয়ে যেতে পারে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস মানব লিভারে কোন প্রকার প্রদাহ না করেও দীর্ঘমেয়াদে অবস্থান করতে পারে। একে বলে ক্যারিয়ার দশা। এছাড়া হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ উভয় ভাইরাসের কারণে লিভারে দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ হতে থাকলে লিভারের গাঠনিক পরিবর্তন চলে আসে এবং লিভার কার্যক্ষমতা কমে যায়। এ অবস্থাকে বলে লিভার সিরোসিস। কোন কোন ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।
 
হেপাটাইটিস ভাইরাস সংক্রান্ত পরিসংখ্যান-
পৃথিবীতে একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস-এর আক্রান্ত রোগীদের ৩০ শতাংশ-এর রক্তে হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস পাওয়া যায় এবং আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৯০ শতাংশ। প্রতি বছর প্রায় দুই কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের একটি অংশের লিভার-এ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস এত বেশি প্রদাহ করতে সক্ষম হয় যে, তারা ফালমিনেন্ট হেপাটিক ফেইলিওর হয়ে মৃত্যুবরণ করে। সাধারণত: কমবয়স্ক একাধিকবার গর্ভধারণকারীনি মহিলারা ‘ই’ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে হেপাটিক ফেইলিওর হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করেছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই শত কোটি মানুষ জীবনের কোন না কোন সময় ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তন্মধ্যে ২৪ কোটি মানুষ লিভারে ‘বি’ ভাইরাসের জীবাণু বহন করছে। প্রতি বছর হেপাটাইটিস ‘বি’-এর কারণে প্রায় ৬ লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বিশ্বের ১ কোটি ৩০ লক্ষ ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ মেয়াদী হেপাটাইটিস ‘সি’ রোগে ভুগছে। প্রতি বছর প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ এই কারণে মৃত্যুবরণ করছে।
 
হেপাটাইটিসের উপরোক্ত পরিসংখ্যান-এ আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ অন্যতম অংশীদার। ২০১৬ সালের ইউরেশিয়ান জার্নাল অব হেপাটো-গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে প্রকাশিত একটি রিভিও আর্টিকেল অনুযায়ী বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ এর প্রাদুর্ভাব প্রায় ৫ থেকে ৭ শতাংশ। হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস-এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় ০.২ থেকে ১ শতাংশ মানুষ তাদের লিভারে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস বহন করছে। একটি গবেষণা অনুযায়ী, হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাস আমাদের দেশে যথাক্রমে ৬০ ও ৩০ শতাংশ লিভার সিরোসিস এবং যথাক্রমে ৬৪ ও ১৭ শতাংশ হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা (লিভার ক্যান্সার) এর রোগীর জন্য দায়ী। বাংলাদেশে একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিসের বেশীরভাগ হয় হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস দ্বারা। একটি গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ‘ই’ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ২২.৫ শতাংশ। অরেকটি গবেষণায় বলেছে, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস-এর ক্ষেত্রে উক্ত ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশে ভাইরাল হেপাটাইটিস সারা বছর জুড়ে হয় এবং বিভিন্ন সময়ে মহামারী আকারে দেখা দেয়। বিশেষ করে বন্যা পরবর্তী সময়ে বাস্তহারা মানুষদের বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তৈরী হয়। যা ‘ই’ ভাইরাস জনিত ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী।
 
হেপাইটিস রোগের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ-
একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহের প্রধান লক্ষণগুলো হলো- জন্ডিস, খাবারে অরুচি, উপরের পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি, দুর্বলতা ও জ্বর। এছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে লিভার প্রদাহ অনেক বেশি মাত্রায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক বেশি জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। এমনকি প্রদাহের প্রচন্ডতায় লিভারের কার্যকারিতা চুড়ান্তভাবে নষ্ট হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। অন্যদিকে ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস তথা দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহে ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় লিভারের কোষে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, ফলে কোন সুস্পষ্ট লক্ষণ পাওয়া যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব ও পেটের ডানদিকের উপরিভাগে হালকা ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। কিন্তু যাদের ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস হয়ে যায় তাদের ক্ষুধামন্দা, পেটের অসুখ, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সার হলে শরীরের ওজন আশংকাজনকভাবে হ্রাস পায় এবং পেপে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়। (চলবে)

 
লেখক: পরিচালক

দ্য লিভার সেন্টার, ঢাকা, বাংলাদেশ

মির্জা গোলাম হাফিজ রোড

বাড়ী নং-৬৪, রোড নং-৮/এ

ধানমন্ডি, ঢাকা

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: