
মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের ব্যয় হ্রাস এবং পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানির এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মুনাফা ব্যাপকভাবে কমেছে। তামাক থেকে শুরু করে জুতা ও ইলেকট্রনিক্স পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে এই প্রভাব দেখা গেছে।
স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৪টি তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির সম্মিলিত নিট মুনাফা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ কমে ১ হাজার৬০৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে এটি আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চাহিদা কমে যাওয়া, অর্থায়নের খরচ বৃদ্ধি এবং কাঁচামালের দামের ওপর চাপ পড়ার কারণে এমনটা হয়েছে।
মুদ্রানীতির প্রভাব
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে, যার ফলে সামগ্রিক চাহিদা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কোম্পানিগুলোর বিক্রি বা টপলাইনে।তাঁরাআরও বলেন, “বিক্রি কমলে মুনাফা কমে যায়। তাছাড়া, ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বাড়ায় ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়েছে, যা কোম্পানির নিট মুনাফাকে আরও সংকুচিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রেখেছে। জুনে বার্ষিক গড় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ১০.০৩ শতাংশ হয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ৯.৭৩ শতাংশ।
ক্ষতির মুখে কিছু কোম্পানি
এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বাটা শু এবং সিঙ্গার বাংলাদেশের মতো বড় কোম্পানিগুলো লোকসানে পড়েছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে তারা লাভে ছিল। অন্যদিকে, আরএকে সিরামিকস এবারও লোকসানে রয়ে গেছে।
বাটা শু: কোম্পানিটি এই প্রান্তিকে প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। তাদের অর্ধ-বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাংচুরের কারণে বেশ কিছু খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রে কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় বিক্রি ৩৯ শতাংশ কমে ১৫৮ কোটি টাকা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে তাদের ১৯ কোটি টাকা মুনাফা ছিল।
সিঙ্গার বাংলাদেশ: গত বছরের একই প্রান্তিকে ২৫ কোটি টাকা মুনাফা থাকলেও এবার কোম্পানিটি ৩১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বিজ্ঞাপনের খরচ বৃদ্ধি, ওয়ারেন্টি ক্লেইম, ব্যাংক চার্জ এবং জাহাজ আটকে থাকার কারণে ডেমারেজ খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের মুনাফা কমেছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ: কোম্পানিটি ৮১ শতাংশ মুনাফা পতনের কথা জানিয়েছে। তারা জানায়, বিক্রি কমে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতির কারণে খরচ বৃদ্ধি এবং ঢাকা কারখানার স্থান বন্ধ করার কারণে এই লোকসান হয়েছে।
আরএকে সিরামিকস: এই প্রান্তিকে তাদের রাজস্ব ১৫ শতাংশ বেড়ে ১৬৩ কোটি টাকা হলেও তারা ১৮.৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের লোকসানের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। কোম্পানিটি জানায়, বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় কোম্পানিটির বিক্রি কমেছে।
মুনাফার ব্যতিক্রম
এই কঠিন সময়েও কিছু বহুজাতিক কোম্পানি মুনাফা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মেরিকো বাংলাদেশ এবং রবি আজিয়াটা।
মেরিকো বাংলাদেশ: ব্যক্তিগত যত্ন এবং চুলের তেলের পণ্য বিক্রেতা এই কোম্পানিটি স্থিতিশীল চাহিদা এবং খরচ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাজস্ব ও মুনাফা উভয়ই বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
রবি আজিয়াটা লিমিটেড: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর রবি আজিয়াটা তাদের পরিচালন ব্যয় কমানোর মাধ্যমে মুনাফা দ্বিগুণ করেছে। তাদের মুনাফা ১৪০ শতাংশ বেড়ে ২৫৭ কোটি টাকা হয়েছে।
ভবিষ্যৎ সতর্কতা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের বাকি সময়ের জন্য পরিস্থিতি সতর্কতামূলক। ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বেশি থাকায়, যেসব কোম্পানির ঋণের পরিমাণ বেশি, তাদের মুনাফা কমতে থাকবে। তারা আরও জানান, নির্মাণ খাতের সঙ্গে যুক্ত সিমেন্ট, স্টিল এবং পেইন্টস কোম্পানিগুলোর তেমন বড় কোনো প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।