দেশের শেয়ারবাজারে বর্তমানে এক অদ্ভুত বৈসাদৃশ্য তৈরি হয়েছে—দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় কোম্পানির শেয়ারমূল্য বাড়ছে হু হু করে, অথচ শক্তিশালী ও লাভজনক কোম্পানিগুলো অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের পেছনে কাজ করছে গুজব, সিন্ডিকেট ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জল্পনা-কল্পনা—যেখানে মৌলভিত্তি নয়, বরং “মনস্তত্ত্ব” বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, কিছু অখ্যাত ও দুর্বল ওষুধ কোম্পানির শেয়ার এখন দেশের শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারকদের দামের চেয়েও বেশি। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামবি ফার্মার শেয়ার লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৭৮০ টাকায়, আর ফার্মা এইডস ৪৯৬ টাকায়। অথচ দেশের বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারমূল্য মাত্র ২১১ টাকা—অ্যামবির চেয়ে প্রায় চার গুণ কম এবং ফার্মা এইডসের অর্ধেকেরও নিচে।
এই বৈষম্য কেবল ওষুধ খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রায় অচল কয়েকটি কোম্পানিও এখন ডিএসইর সর্বোচ্চ দামের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্লেষণ বলছে, এসব কোম্পানির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো—তারা মূলত দ্রুত মূলধন মুনাফা দেয়, কিন্তু ডিভিডেন্ড প্রদানে দুর্বল। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উল্টোচিত্র তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেটের প্রভাব ও গুজবনির্ভর কেনাবেচার কারণে। বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতিতে বাজার ক্রমেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ডিএসইতে বর্তমানে তালিকাভুক্ত ৩৬০টি কোম্পানির মধ্যে ১০১টি ‘জেড’ বা দুর্বল ক্যাটাগরিতে। তবু এসব কোম্পানির ১৮ শতাংশের শেয়ারমূল্য ৩০ টাকার ওপরে, যেখানে এ-ক্যাটাগরির প্রায় অর্ধেক কোম্পানি ৩০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে।
ছয় বছর ধরে ডিভিডেন্ড না দেওয়া একটি জেড-ক্যাটাগরির কোম্পানি রেনউইক যজ্ঞেশ্বর এখন ৪৮৭ টাকায় লেনদেন হচ্ছে—যা ডিএসইর শীর্ষ ২০ দামের শেয়ারগুলোর একটি। একইভাবে লিবরা ইনফিউশন, যা ২০২২ সালের পর থেকে ডিভিডেন্ড দেয়নি, এর দাম ৬১০ টাকা। অন্যদিকে, জিকিউ বলপেন (বি-ক্যাটাগরি) গত বছর ৩ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে, কিন্তু ৩ কোটি টাকা লোকসান থাকা সত্ত্বেও শেয়ারটি এখন ৫১৮ টাকায়। কে অ্যান্ড কিউ ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়ে ৩৯৩ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ফাইন ফুডসও ২৯৬ টাকায় উঠে এসেছে। বিপরীতে গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো বহু বছর ধরে ১০০ শতাংশের ওপরে ডিভিডেন্ড দিচ্ছে, তবু তাদের শেয়ার নেই শীর্ষমূল্যের তালিকায়।
একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী বলেন, “আমাদের বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অভাবই এই অস্থিরতার মূল কারণ। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও সিন্ডিকেট মিলে সীমিত সংখ্যক শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে”।
তিনি মনে করেন, “যেসব কোম্পানি বছর বছর ডিভিডেন্ড দেয় না বা বন্ধ রয়েছে, সেগুলো ডিলিস্ট করতে হবে। আর ভালো শেয়ার বাজারে আনতে হবে”। তার ভাষায়, “সংস্কার সবসময় কষ্টদায়ক, কিন্তু বাজার সুস্থ রাখতে সার্জারি করতেই হবে”।
বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে গুজবের দাপটে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে মৌলভিত্তিই জয়ী হয়। তাই ধৈর্যশীল বিনিয়োগকারীদের জন্য এখনই সময়—ভালো শেয়ার কম দামে সংগ্রহের।






















