ঢাকা   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের এমডি পেলেন ‘থার্ড ক্লাস’ রেটিং

শেয়ারবাজার

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ২৯ জুলাই ২০২৫

ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের এমডি পেলেন ‘থার্ড ক্লাস’ রেটিং

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতের নজিরবিহীন লুটপাটের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। শুধু আর্থিক নয়, প্রশাসনিক ও নিয়োগবিধির চরম অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। জানা গেছে, ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর মেয়াদকালে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠলেও তাকে একাধিকবার গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখা হয়। এসব অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের ফলেই ব্যাংকটি এখন মারাত্মক আর্থিক সংকটে, এমনকি দেউলিয়াত্বের আশঙ্কায় রয়েছে।

সম্প্রতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে গুরুতর অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে অপসারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পর পরিচালনা পর্ষদ এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। তার বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি ও আত্মীয়-স্বজনকে ঋণ দেওয়া এবং জাকাতের অর্থ আত্মসাতের মতো গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে অডিট কমিটি।


সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, এমডি হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর এবং ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এমডি নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, এমডি বা সিইও নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়েই তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। অথচ সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতকে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি রয়েছে। শুধুমাত্র মাস্টার্সে তার দ্বিতীয় শ্রেণির সার্টিফিকেট ছিল।

২০১৫ সালের ৫ মার্চ সৈয়দ ওয়াসেক আলী চুক্তিভিত্তিক এমডি হিসেবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব নেন এবং দুই দফায় তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে তিনি বাধ্যতামূলক ছুটিতে ছিলেন।

বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকের কার্যক্রমে অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত নিরীক্ষায় ওয়াসেক আলীর বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০২৫ সালের ১ জুন অনুষ্ঠিত ১০৭তম অডিট কমিটির সভায় এসব অনিয়মের বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ব্যাংকের বিপুলসংখ্যক আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সঙ্গে সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।


অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যেসব উল্লেখযোগ্য অনিয়মের উল্লেখ করা হয়েছে:


বেনামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ: ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে।

বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে ঋণ: ব্যাংক নীতিমালা উপেক্ষা করে নির্ধারিত সীমার বাইরে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।

জামানতের অস্বাভাবিক মূল্যায়ন: ঋণের বিপরীতে জামানত বা বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেশি দেখানো হয়েছে।

অনাবৃত জামানতের বিপরীতে ঋণ: পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

মুনাফা মওকুফের নামে মূলধন মওকুফ: মুনাফা মওকুফের অজুহাতে মূল অর্থও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

নিয়মবহির্ভূতভাবে মুনাফা বিতরণ: স্থায়ী আমানতের বিপরীতে নিয়মবহির্ভূতভাবে মুনাফা বিতরণের নামে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।


নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম: নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গুরুতর অনিয়ম এবং আঞ্চলিক বৈষম্য করা হয়েছে।


বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা: চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষে পুনর্নিয়োগ ছাড়া একজন নির্বাহীকে বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা এবং তাকে বেতন ও বোনাস প্রদান করা হয়েছে।

কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও বিল উত্তোলন: কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিল উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

জাকাত-সিএসআর ফান্ড বিতরণে অনিয়ম: জাকাত ও সিএসআর (কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব) ফান্ডের অর্থ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে।

নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম: নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গুরুতর অনিয়ম এবং আঞ্চলিক বৈষম্য করা হয়েছে।

বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা: চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষে পুনর্নিয়োগ ছাড়া একজন নির্বাহীকে বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা এবং তাকে বেতন ও বোনাস প্রদান করা হয়েছে।

কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও বিল উত্তোলন: কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিল উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

জাকাত-সিএসআর ফান্ড বিতরণে অনিয়ম: জাকাত ও সিএসআর (কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব) ফান্ডের অর্থ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে।

এস আলমের ব্যাংক লুটের অন্যতম সহযোগী হিসেবে ওয়াসেক আলী কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার এই অসততা ও অদক্ষতায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এখন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ৯৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটির ৪৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের প্রায় ৯৫ শতাংশ। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এখন এক হাজার ২০৮ কোটি টাকা এবং লোকসান ৪০৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত দল ওয়াসেক আলীর সংশ্লিষ্টতায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সিএসআর ফান্ডের টাকা বিতরণেও ব্যাপক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। গত দুই বছরে বিভিন্ন জেলায় বিতরণ করা প্রায় ১৫ কোটি টাকা যেসব প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করার কথা বলা হয়েছে, তদন্ত দল সেসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকার্স ফোরামকে দেওয়া ১০ কোটি টাকার বিতরণেও অনিয়ম ধরা পড়েছে।


এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ফরেনসিক অডিট করা হয়েছিল। সেখানে ছুটিতে থাকা এমডির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। এজন্য বোর্ডের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তার নিয়োগ বাতিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই চিঠির আবেদন অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। নতুন নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর একাডেমিক বিষয়সহ তার সততা ও দক্ষতা যাচাই করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ব্যাংক এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।