facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪

Walton

বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ


১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ সোমবার, ১১:২০  এএম

স্টাফ রিপোর্টার

শেয়ার বিজনেস24.কম


বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ২০২১ সালের যে আর্থিক প্রতিবেদন ৯ মাস পর প্রকাশ করেছে, তাতে হিসাবের মান রক্ষা হয়েছে কি না, তা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

কোম্পানিটি ওই বছরের তিন প্রান্তিক অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ২ টাকা ৭৫ পয়সা দেখায়। কোম্পানিটির যে শেয়ারসংখ্যা, তার হিসাবে ৯ মাসে মুনাফা দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২১৮ টাকা।

তবে গোটা অর্থবছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি ৯৯ পয়সা লোকসান হয়েছে বলে জানানো হয়। অর্থাৎ ৯ মাসে যে পরিমাণ আয় হয়েছে, পরের তিন মাসে সেখান থেকে কমে গেছে এর চেয়ে বেশি।

এই হিসাবে ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৭৯ হাজার ৫৫৮ টাকা। অর্থাৎ এই তিন মাসে লোকসান হয়েছে ৫২ কোটি ৬৯ লাখ ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা।

কোম্পানিটি লোকসান করলেও বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অনুমোদনের ওপর নির্ভর করবে।

এই লভ্যাংশ যে বিনিয়োগকারীদের পছন্দ হয়নি, সেটি লেনদেনেই স্পষ্ট। লভ্যাংশ প্রকাশের দিন কোম্পানিটির শেয়ারদর কমেছে ১ টাকা ৪০ পয়সা। বর্তমান দর ২৩ টাকা ৯০ পয়সা। এটিই কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস, অর্থাৎ এর চেয়ে নিচে নামা আসলে সম্ভব নয়। এই বাধা না থাকলে দর কোথায় দাঁড়াত, সেটি জানা সম্ভব নয় কোনোভাবে। কারণ লভ্যাংশের ঘোষণার কারণে বৃহস্পতিবার শেয়ারের কোনো মূল্যসীমা ছিল না।

কোম্পানিটি তার লভ্যাংশ ঘোষণার পর শেয়ারপ্রতি আয়ে এই পরিবর্তনের একটি ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, তাদের ঋণ আদায় সন্তোষজনক ছিল না। আর অনাদায়ী এই ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে শেয়ারপ্রতি আয় কমে গেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, এই সঞ্চিতি কি কেবল শেষ তিন মাসে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে ৯ মাসের মুনাফা দেখে যারা ভালো লভ্যাংশের আশায় শেয়ারে বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়েছেন, তাদের দায়ভার কে নেবে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে প্রতি তিন মাস অন্তত তাদের লাভ-লোকসানের হিসাব প্রকাশ করতে হয়, যাকে বলা হয় প্রান্তিক প্রতিবেদন। এর মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন কেবল নিরীক্ষিত থাকে, বাকি তিনটি প্রতিবেদন নিরীক্ষা না করার কারণে তাতে কারসাজির সুযোগ থাকে।

বিভিন্ন কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা গেছে, কোনো প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। তাতে শেয়ারদরও দেয় লাফ। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা কমে যায়।

২০২১ সালে বিবিধ খাতের একটি কোম্পানির শেয়ারদর ৯ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা ছুঁইছুঁই হয়ে যায়। কোম্পানিটি তার স্বাভাবিক আয়ের চেয়ে অনেক বেশি আয় দেখাতে থাকে প্রান্তিক প্রতিবেদনে। তিন প্রান্তিক শেষে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২৫ পয়সা আয় দেখানোর পর চূড়ান্ত আয় দেখানো হয় ১৮ পয়সা। এরপর কোম্পানির দর কমতে কমতে এখন ১৬ টাকা ৭০ পয়সায় নেমেছে। সব প্রভিশনিং শেষ প্রান্তিকে!

বে লিজিং জানিয়েছে, গত অর্থবছরে মোট ৫৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে।

শেষ প্রান্তিকে এসে বড় সঞ্চিতি সংরক্ষণের কথা বলেছে, সেটা আগের তিন প্রান্তিকে কেন রাখা হয়নি- এমন প্রশ্নে কোম্পানি সচিব শারমিন আক্তার নিউজবাংলকে বলেন ,‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিশন রুল পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের বড় কয়েকজন গ্রাহক সময়মতো টাকা দেননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে আমাদের প্রভিশন করতে হয়েছে।’

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘নিয়ম হচ্ছে প্রতি কোয়ার্টারে প্রভিশন রাখতে হয়। একবারে বছর শেষে প্রভিশন রাখা এটা সঠিক নিয়ম নয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কথা বে লিজিংয়ের কোম্পানি সচিব বলেছেন, সেটি জানালে স্নেহাশীষ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেখে নিয়ম পরিপালন হচ্ছে না, সে তো চাপ দেবেই। প্রভিশন রাখা দরকার ছিল কিন্তু প্রভিশন রাখা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা করিয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘সেটা রেয়ার কেস।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলামও বলেছেন, বে লিজিং যা করেছে, সেটিতে হিসাবমান বজায় থাকেনি। তিনি একে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে দেখছেন।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটা প্রতারণা আর অব্যবস্থাপনা। প্রভিশন প্রতি কোয়ার্টারে রাখতে হয়। সেটা না রেখে ৯ মাসে ভালো মুনাফা দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়েছে। তাদের বড় ক্ষতির মধ্যে ফেলা হয়েছে।’

যোগাযোগ করা হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, ‘সঞ্চিতির বিষয়টি অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে করে। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, সেটি আমরা তদন্ত করে দেখব।’

অর্থবছর শেষ হওয়ার ৯ মাস পর লভ্যাংশ ঘোষণার বিষয়ে অন্য একটি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন তো অর্থবছর শেষ হওয়ার চার মাসের মধ্যে দেয়ার কথা। কেন এত দেরি করল, সেটিও খতিয়ে দেখব।’

প্রান্তিক প্রতিবেদন : বে লিজিং ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মুনাফা দেখায় শেয়ারপ্রতি ৩১ পয়সা।

যে প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে, সেটি কোম্পানিটি প্রকাশ করে ৩০ সেপ্টেম্বর।

একই দিন প্রকাশ করা হয় দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্যও। জানানো হয়, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৪৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ। ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল কেবল ২ পয়সা।

ওই বছরের ২৮ অক্টোবর প্রকাশ হয় কোম্পানিটির তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব। ওই প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় আবার দেয় লাফ। জানানো হয় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে শেয়ারপ্রতি আয় হয় ১ টাকা ৯৫ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ৯১ পয়সা। তিন প্রান্তিক মিলিয়ে শেয়ারপ্রতি আয় দাঁড়ায় ২ টাকা ৭৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা ২ পয়সা।

কোম্পানিটি ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল, শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ১ টাকা ১৪ পয়সা।

এবার আয় বাড়লে লভ্যাংশও বাড়তে পারে- এই আশায় যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা এখন হতাশ।

এদিকে বে লিজিং ২০২১ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন দিলে তারা এই লভ্যাংশ দিতে পারবে।

আগামী ৩০ অক্টোবর সাধারণ সভায় এবারের লভ্যাংশের অনুমোদন নিতে হবে। সে জন্য রেকর্ড ডেট ঠিক হয়েছে ৬ অক্টোবর।

সেখানে অনুমোদন পেলে বে লিজিংয়ের ১০০টি শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীরা পাঁচটি করে শেয়ার পাবেন।

২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে।

২০১৮ অর্থবছরে বে লিজিং ২১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছিল; লভ্যাংশ দিয়েছিল শেয়ারপ্রতি ১ টাকা।

২০১৯ অর্থবছরে মুনাফা করে ১৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। লভ্যাংশ দেওয়া হয় ৭৫ পয়সা। এ ছাড়া প্রতি ১০০ শেয়ারে নতুন ২ দশমিক ৫০টি শেয়ার।

২০২০ অর্থবছরে মুনাফা করে ১৬ কোটি টাকা। লভ্যাংশ দেওয়া হয় ১ টাকা।

পুঁজিবাজারে এ কোম্পানির ১৪ কোটি ৮ লাখ ৮৮ হাজার শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ আছে পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ শেয়ার, বিদেশিদের হাতে আছে দশমিক ১৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ শেয়ার।

কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১৪০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা; রিজার্ভের পরিমাণ ১২৬ কোটি ৩ লাখ টাকা।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: