facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪

Walton

ঋণ-আমানত অনুপাত, সুদের হার ও শেয়ারবাজারের সূচকপতন


০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার, ০৪:০৩  পিএম

আবু আহমেদ


ঋণ-আমানত অনুপাত, সুদের হার ও শেয়ারবাজারের সূচকপতন

 

শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মন ভালো নেই। তারা দেখলেন পুরো জানুয়ারিব্যাপীই তাদের ধারণকৃত শেয়ারের মূল্যের পতন হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতেও যে অবস্থার উন্নতি হবে এমনটা তারা দেখছেন না।

তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আশা করছেন, সামনে ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানি এবং তার সঙ্গে বীমা কোম্পানিগুলোর মুনাফা বণ্টনের ঘোষণা এলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। গেল বছর শেয়ারবাজারের জন্য ভালোই গেছে। অল্প সময়ে অন্তত সূচক ৫০০ পয়েন্ট বেড়েছে। একপর্যায়ে সূচক ৬ হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে যায়। আশাবাদীরা ভাবলেন, সূচক আরো বাড়বে। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ করা গেল, সূচক পেছনে যাচ্ছে। ভালো কোনো কারণ স্পষ্ট হলো না। পরে সংবাদমাধ্যম থেকে যা জানা গেল তা হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের লাগাম টেনে ধরতে এক নির্দেশনা জারি করেছে। তাতে নাকি ব্যাংকগুলো তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারগুলো বেচতে বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছে। এতে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বেড়ে গেছে। ফলে শেয়ারমূল্যের বড় রকমের পতন ঘটেছে। ছোট পতন হলে বলা হয় মূল্যের সংশোধন, বিশেষ করে উপরে উঠে নিচে নেমে এলে। তবে সংশোধন পর্যায়ে সব গেইন নিঃশেষ হয়ে যায় না। নিট হিসাবে মূল্যসূচক উপরে থাকে। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় মার্কেট স্বাভাবিক সংশোধন হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন না। তারা যা বলতে চাইছেন তা হলো, ঋণ-আমানতের অনুপাত কমানোর ফলে ব্যাংকগুলো শেয়ার বেচে তারল্যের জোগান দিয়েছে। শেয়ারের সেই বাড়তি সরবরাহকে অন্য বিনিয়োগকারীরা হজম করতে পারেননি। তাদের কাছে হিসাবটা সহজ। সেটা হলো, ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর হুকুমের কারণে শেয়ারবাজার থেকে কিছু অর্থ বের হয়ে গেছে। আর অর্থ বের হলে তো বাজারের মূল্যসূচক নিম্নমুখী হবেই! ঠিক কী পরিমাণ অর্থ শুধু এডিআর কমানোর কারণেই বের হয়েছে, সেটা কিন্তু কেউ জানে না। কেউ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাঁড় করাতে পারলে হয়তো বোঝা যেত। এডিআর কমানোর খবরের সঙ্গে আরো একটি উপাদান যোগ হয়েছে শেয়ারের মূল্য কমার ক্ষেত্রে। আর সেটা হলো— মুদ্রানীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংক আগে থেকে যা বলে আসছিল, তাতে অনেক বিনিয়োগকারী ধারণা করেই নিয়েছিলেন যে, এবারের মুদ্রানীতি হবে সংকোচনমূলক; যার ফলে বাজারে সুদের হার বাড়তে পারে এবং শুধু সুদের হার বৃদ্ধির কারণেই শেয়ারবাজার থেকে কিছু অর্থ বের হয়ে যেতে পারে। তাই তারাও আপাতত শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকলেন। তাদের ভয় হয়েছিল, সুদের হার বৃদ্ধির কারণে পাছে শেয়ারের মূল্য পড়ে গিয়ে তারা ক্যাপিটাল লসের সম্মুখীন হন। তাদের সেই ভাবনার মধ্যে যুক্তি ছিল। সেটা হলো, বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে স্বাভাবিক সময়ে শেয়ারের মূল্যসূচকের মধ্যে এবং বাজারে সুদের হারের মধ্যে একটা নেতিবাচক সম্পর্ক আছে। সুদের হার বাড়লে শেয়ারমূল্য পড়ে, সুদের হার কমলে শেয়ারমূল্য বাড়ে— এটাই হলো তত্ত্বীয় অবস্থান। তবে এ দুই চলকও একসঙ্গে চলতে পারে। তবে সেই চলা একটা পর্যায় পর্যন্ত। অবশেষে তাদের মধ্যে উল্টো সম্পর্ক স্থাপিত হবেই। সুদের হার কমলে ঋণ করার মূল্য অনেক কমে যায়। ফলে অনেকে ঋণ করে ঋণপত্র (বন্ড) ও শেয়ার কেনেন।

অন্যদিকে সুদের হার বৃদ্ধি পেলে অর্থের সুযোগ ব্যয়টা আর্থিক বাজারেই বেশি হয়। এবং অর্থ শেয়ারবাজার থেকে সরে মানি মার্কেট বা মুদ্রাবাজারে বেশি ব্যবহূত হয়। গত এক দশক বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিতে নিম্ন সুদের সময় গেছে। ফলে ওইসব অর্থনীতিতে ঋণপত্র এবং ইকুইটি বা শেয়ারের মূল্য বেশি ছিল। তবে শেয়ারের মূল্য মোটের ওপর কোথায় যাবে বা কোথায় যাচ্ছে, তা নির্ভর করে প্রকৃত অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর, অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ধরনের ওপর এবং বিনিয়োগকারীদের আশাবাদের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার শেয়ারবাজার ওয়াল স্ট্রিটের এ উত্থান কেন হলো? দুটো উপাদান কাজ করেছে এই অভাবনীয় উত্থানের পেছনে। তা হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক তাদের কোম্পানিগুলোর মুনাফায় উেস কর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২১ শতাংশে নিয়ে আসা। করের হারের এই বড় কর্তনের পেছনে আমেরিকার ধনী লোকদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। এবং এ কর্তনে ডেমোক্র্যাটরাও সমর্থন দিয়েছে। অন্য উপাদান হলো, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশাবাদের একটা উত্থান ঘটেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। তাদের বাজারেও বড় রকমের সংশোধনের সময় হয়তো হয়ে গেছে। তবে সেই সংশোধনের পরও ওয়াল স্ট্রিটের সূচক আগের তুলনায় অভাবনীয় উচ্চতায় থাকবে। আমাদের এখানেও অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি— এ দুটো উপাদান শেয়ারবাজারকে অবশ্যই প্রভাবিত করে। বিনিয়োগকারীদের ভাবনা যে ভুল, সেটা বলব না। তারা দেখছেন মুদ্রানীতিটা বাজারকে আপাতত আঘাত না করলেও শেয়ারবাজার সহায়ক হয়নি মোটেই। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করলে অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হবে না। সেক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধিও পাব না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতি দ্বারা সুদের হার বাড়াতে চায়। তাহলে তো শেয়ারবাজার চাপে থাকবেই। অবশ্য সুদের হার বাড়ানোর মধ্যে আমি কোনো অর্থনীতি খুঁজে পাই না। বরং যার ওপর জোর দেয়া উচিত ছিল সেটা হলো, আমানত ও ঋণের সুদের হারের মধ্যে ব্যবধানের ওপর, যাকে বলা হয় স্প্রেড। এটা এ অর্থনীতিতে বেশি। কুঋণই হলো এ উপাদানের বেশির জন্য দায়ী। আশা করি, বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কোমরটা শক্ত করে দাঁড়াবে। সুদের হার বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি ছিল, ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে ব্যক্তি খাতে বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে। তারা তারল্য সংকটে পড়েছে। সুতরাং সুদের হার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করে নির্দেশিত এডিআর ঠিক রাখো। সুদের হারের সঙ্গে আমানতের একটা সম্পর্ক আছে বটে, তবে সেই সম্পর্ক অতটা মজবুত নয়। যেসব দেশে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি, সেসব দেশের ব্যাংকগুলো কি আমানত পাচ্ছে না! মানুষ কি সুদের জন্যই ব্যাংকে অর্থ রাখে? কেউ কেউ বলছে, ব্যাংকে সুদের হার কম থাকার জন্য অর্থ শেয়ারবাজার এবং সঞ্চয়পত্রে চলে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্রের অর্থও তো শেষ পর্যন্ত আমানত হিসেবে ব্যাংকেই ফেরত আসছে। সরকার কি সঞ্চয়পত্র বিক্রির অর্থ নিজের কাছে ফেলে রাখে! সেই অর্থ তো সরকারি হিসাবে ব্যাংকেই জমা হচ্ছে। অর্থনীতিতে মোট আমানত কমতে পারে তিন কারণে। এক. বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মুদ্রা সরবরাহ (এম২) কমিয়ে দেয়।

দুই. লোকে যদি ক্যাশ বা নগদ অর্থ ধারণকে প্রাধান্য দেয়। অন্য কারণটি হলো, অর্থনীতি যদি আগের তুলনায় ধীরে চলে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে উপরের তিনটি কারণের মধ্যে কোনোটিরই যদি উদ্ভব না ঘটে তাহলে আমানত কমবে কেন?

যেটা হতে পারে সেটা হলো, মোট আমানত ঠিকই থাকবে বরং বাড়বে যদি মুদ্রা সরবরাহ (এম২) বাড়ে। কিন্তু ব্যাংকে আমানত কোন হিসাবে জমা পড়বে সেটার ধরন পরিবর্তন হতে পারে। যেমন— সুদের হার কম থাকলে টার্ম ডিপোজিট বা মেয়াদি আমানত কমে যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে চলতি হিসাবে আমানত বাড়বে। অর্থনীতিতে মোট আমানত বাড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি একটা বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করে তাহলে আমানত ধীরে বাড়বে। যদি বিনিয়োগকে সমর্থন দেয়ার জন্য মুদ্রানীতি অবলম্বন করে তাহলে আমানতও বেশি হারে বাড়বে। অর্থনীতি যদি বেশি জোরে চলে তাহলে অর্থনীতিতে মুদ্রা ব্যবহারের ঘনত্বও বৃদ্ধি পায়। সেই ক্ষেত্রে মানি মাল্টিপ্লায়ারের মান বেড়ে আমানত বাড়বে। শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজার বা শেয়ারবাজার এবং অর্থনীতির অন্য আর্থিক বাজারগুলো মূল্যের দিক দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শেয়ারবাজার থেকে কিছু অর্থ বের হয়ে গেলে যে শেয়ারের মূল্য সবসময় একই অবস্থানে বা নিম্নে পড়ে থাকবে এ ধারণাও ঠিক নয়। বরং অর্থ বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুষিয়ে দিতে পারে যদি দেখা যায় কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা দিচ্ছে। তখন বিনিয়োগের ওপর ইল্ড রেটটি বেড়ে গিয়ে বেশি অর্থকে শেয়ারবাজারের দিকে টানতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শেয়ারবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটো উপাদান হলো, করপোরেট ট্যাক্স এবং বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে সুশাসন। করপোরেট আয়কর কমালে সেটা সরাসরি শেয়ারবাজারের স্বার্থের পক্ষে যাবে। আর যারা এ বাজার থেকে অর্থ নিয়েছে, তাদেরকে একটা দায়বদ্ধতার ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে রাখতে পারলে সেটাও শেয়ারবাজারের পক্ষে যাবে।

 

লেখক: অর্থনীতিবিদ

অনারারি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: