facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার, ২০২৪

Walton

এক মাসের জিম্মিকাল যেভাবে কেটেছে নাবিকদের


১৬ এপ্রিল ২০২৪ মঙ্গলবার, ১২:৫৭  পিএম

ডেস্ক রিপোর্ট

শেয়ার বিজনেস24.কম


এক মাসের জিম্মিকাল যেভাবে কেটেছে নাবিকদের

এক মাসের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা গন্তব্যের পথ ধরেছেন। দীর্ঘ জিম্মিকাল কীভাবে কেটেছে সেই গল্প গণমাধ্যমকে শুনিয়েছেন জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘সোমালিয়ান জলদস্যুদের জাহাজ ছিনতাইয়ের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু নিজেরা এ ধরনের একটি ঘটনার শিকার হব তা ছিল কল্পনার বাইরে।’

জাহাজ নিয়ে তারা হাই রিস্ক এরিয়ার বাইরে ছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা কেউই এ ধরনের ঘটনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে এমন একটি ঘটনা ঘটে। ওই দিন তৃতীয় রোজা ছিল। আমি ৮টায় ডিউটি অফ করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে সতর্কসংকেত শুনি। এরপর আমরা বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি চালু করি। এরই মধ্যে জলদস্যুরা চলে আসে। মুহূর্তেই সবকিছু হয়ে গেল। তাই মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পাইনি। সবার মধ্যে যে ভয়টা ছিল, জলদস্যুরা জাহাজে উঠেই প্রথমে যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, এ উদ্বেগ। জলদস্যুদের কাছ থেকে আসা প্রথম এই ধাক্কাটা কীভাবে সামাল দেব, আমরা তাই নিয়ে ভয়ের মধ্যে ছিলাম। কারণ আমরা শুনেছিলাম, জাহাজে উঠেই তারা প্রথমে গোলাগুলি করে, মারধর করে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ব্রিজে এসে দেখলাম, তারা প্রথমে ১২ জন ছিল। এদের কেউ ইংরেজি বলতে পারছিল না। তারাই জাহাজটি ছিনতাই করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে জাহাজে জলদস্যুর সংখ্যা বাড়ে। সর্বশেষ যেদিন আমরা মুক্ত হই, ওই দিন জাহাজে ৬৫ জন জলদস্যু ছিল। এরা সোমালিয়ায় নিয়ে আসার পর ধাপে ধাপে জাহাজে উঠেছিল। কিন্তু প্রথমে ১২ জন জলদস্যুই জাহাজটি ছিনতাই করে সোমালিয়ায় নিয়ে আসে। জাহাজে উঠেই তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করেছিল। আমরা তাদের কোনো কথাই বুঝতেছিলাম না। কিছু ফাঁকা গুলিও তারা ছুড়েছে। তবে আমদের কাউকে আঘাত করেনি। এরপর ধীরে ধীরে আমরা তাদের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছি।’

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ভাবছিলাম পরিবারকে কী বলব। শুরুতে ভেবেছিলাম বিষয়টি আমার পরিবারকে জানাব না। তাই আমি আমার পরিবারকে মেসেজ দিয়েছি, আমাদের জাহাজের ওয়াইফাই নষ্ট হয়ে গেছে। দুই-তিন মাস হয়তো কথা বলতে পারব না। আমার মতো বেশিরভাগ নাবিকই একই ইচ্ছা পোষণ করেন। এই মেসেজ দেওয়ার পর আমাদের মোবাইল জমা দিতে বলে দস্যুরা। তবে যাদের দুটি মোবাইল ছিল তাদের কেউ কেউ একটি মোবাইল ব্রিজে লুকিয়ে রেখেছিল। তখন ব্রিজে থাকছিলাম। একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতি। জাহাজে আমাদের জন্য মানসম্মত থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ব্রিজে সবাই একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। অনেক কষ্টকর। ব্রিজে একটামাত্র ওয়াশরুম। ওইটাই ব্যবহার করতে হচ্ছিল ২৩ জনকে। সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ১২ জলদস্যু। শুরুতে আমরা এ ধরনের খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘দস্যুরা ইংরেজিতে অনেক কাঁচা। তাই তাদের কারোই কথা বুঝতে পারছিলাম না। জাহাজ তো আমরা চালাই, কিন্তু জলদস্যুরা হাইজ্যাক করার পর আমাদের তাদের কথায় চালাতে হয়। এটিও ছিল অনেক কষ্টকর। সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি হলো যখন যুদ্ধজাহাজ এবং একটি বিমান এলো। তখন পরিস্থিতি হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়ে গেল। দস্যুরাও ভিন্ন রকম আচরণ করতে শুরু করল। আমাদের চলাফেরা আরও সীমাবদ্ধ করে দিল। বাথরুমেও যেতে দিচ্ছিল না। একবার বলে শুয়ে থাক, আবার বলে বসে থাক, নড়াচড়া যাবে না। অস্ত্র তাক করে রাখে আমাদের দিকে। তারপরে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে বলছে, তোমরা এখনই থামো, না হলে আমরা অভিযান শুরু করব। তখন ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। জলদস্যুরাও মানছে না, যুদ্ধজাহাজও মানছে না। ফাঁকা ফায়ারও শুরু হয়। তখন একটা কান্নাকাটির অবস্থা। এরপর ক্যাপ্টেনকে দিয়ে বার্তা পাঠানো হয়, তোমরা চলে যাও, না হলে আমাদের মেরে ফেলবে।’

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর নৌবাহিনী থামে। থামলেও তাদের যুদ্ধজাহাজ আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন জলদস্যুরা আমাদের ব্রিজে থাকতে বাধ্য করল। ব্রিজে ঘুমাতে হলো। কিন্তু ঘুম তো কোনোভাবেই আসছিল না। কারণ এদিকে ফিরলেও অস্ত্র ওই দিকে ফিরলেও অস্ত্র। সবাই বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম। পরে একটা লুকানো মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেটে ঢুকে জানতে পারি, আমাদের ঘটনা ইতোমধ্যে সারা দেশের মানুষ জানে। তখন আমরা এতটুকু আশ্বস্ত হই।’

তিনি বলেন, ‘প্রথম কয়েক দিন অনেক কড়াকড়ি করত দস্যুরা। পরে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিই। আমরা মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যে ছাড়া পেতে দুই থেকে তিন মাস লাগতে পারে। আমাদের কাছে এক মাসের পানি ছিল। এদিকে আবার জলদস্যুর সংখ্যা বেড়ে গেল। তাই পানি কম ব্যবহার করি। জাহাজে যখন আমরা কাজে থাকি তখন সময়টা কেটে যায়। বাকি সময় নিজেরা গল্প করি। পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু জিম্মি হওয়ার পর আমাদের সেই নরমাল রুটিন চেঞ্জ হয়ে যায়। ফলে সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল।’

তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় আমরা জলদস্যুদের অনুমতি নিয়ে নামাজ পড়লাম। তারা জানে ঈদ আমাদের একটা বড় উৎসব। তা ছাড়া এর মধ্যে তাদের সঙ্গে আমাদের একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। পরে তাদের অনুমতি নিয়ে আমরা একটা ছবি তুললাম। যেটা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। যখন তারা জানছে এই ছবিটা মিডিয়ায় এসেছে, তখন তারা আমাদের আবার চার্জ করেছে। একটু কড়াকড়ি শুরু করেছে। ঈদের দুই-তিন দিন পর খেয়াল করলাম দস্যুদের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। তাদের মধ্যে একটা বাড়ি যাওয়া বাড়ি যাওয়া ভাব এসেছে। তারা অনেক উৎফুল্ল। তখন আমাদের মাথায় কাজ করছিল যে মনে হয় কিছু একটা হতে যাচ্ছে। এরপর তারা আমাদের সবার ছবি নিল, ভিডিও নিল। পরের দিন শুনলাম দস্যুরা চলে যাবে। তারা যাবে যাবে করতে করতে রাত ১২টার গেল।’

গত ১২ মার্চ জিম্মি হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল মুক্ত হন জাহাজসহ নাবিকরা।

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘তারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে যে ক্লান্তি ছিল তা যেন মুহূর্তেই কমে গেল। এখনও ঘুম থেকে উঠলে মনে হয় যেন একটা স্বপ্ন দেখছি। এত দ্রুত মুক্ত হব এটা আমরা আশা করিনি। এজন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। জাহাজের মালিকপক্ষসহ আরও যারা কাজ করেছেন তাদের কাছে আমরা ও আমাদের পরিবার চিরকৃতজ্ঞ। দেশের মানুষ আমাদের যে ভালোবাসা দেখিয়েছে তাদের কাছেও আমরা চিরকৃতজ্ঞ।’

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: