facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৭ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪

Walton

প্রতিক্রিয়া : ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের একচেটিয়া!


০৯ মে ২০১৭ মঙ্গলবার, ০৮:১৭  পিএম

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

শেয়ার বিজনেস24.কম


প্রতিক্রিয়া : ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের একচেটিয়া!

বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম কিংবা পরিবারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং আইন ও বিধিমালা সময়-সময় সংশোধন হয়ে থাকে। তবে তখন কিছু নীতি মান্য করা হয়। ব্যাংকের স্বার্থ মানে তো শুধু একটি পরিবারের নয়, সব আমানতকারীর স্বার্থও তো দেখতে হয়। এবারের সংশোধনের বিষয়ে ড. ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদের নেতৃত্বে যে ব্যাংকিং কমিশন হয়েছিল, তাতে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ একজন সদস্য পরিচালনা বোর্ডে রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। তা সত্বেও সরকার সংখ্যাটা দুজন করেছিল। আমি মনে করি, এতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তা ছাড়া একটানা নয় বছর ওই পদে কারও থাকাও নজিরবিহীন। এর ফলে গোটা কাঠামোটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। বোর্ডের বাকিরা নিস্পৃহ ও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে।

বর্তমানে ৪০টি ব্যাংকে দেখা যাচ্ছে, মালিকদের টাকা ২ দশমিক ৫ শতাংশের সামান্য বেশি। সাধারণত বেসরকারি ব্যাংকে জনগণের টাকা থাকে গড়ে ৯০ শতাংশের ওপরে। এ জন্যই পরিচালনা পর্ষদে অংশীদারদের প্রতিনিধিত্ব ব্যাপকভিত্তিক করতে হয়। আমরা ব্রিটিশ ব্যাংকিং সিস্টেমে অনুসরণ করি, যেখানে বহুপক্ষীয় (ব্রড বেজড) বোর্ড থাকাই নিয়ম। এক পরিবার থেকে চারজন যদি নয় বছর করে থাকেন, তাহলে বোর্ড সম্পূর্ণ পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। জনগণের কষ্টের টাকার সঞ্চয়ের সঠিক বিনিয়োগের সুযোগও কমে যাবে। এতে ব্যাংকের নাজুকতা বাড়বে। ব্যাংকের মালিকেরা বেশি হারে পরিচালনা পর্ষদে থাকলে ব্যাংকের ভাল ভাল হবে, বিচক্ষণ বিনিয়োগ হবে; এমন দাবি যুক্তিযুক্তও নয়, বাস্তববাদীও নয়। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেল, সর্বময় ক্ষমতাধরেরা বেশ কয়েকটি ব্যাংককে শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে গেছেন।

আমাদের দেশের বিদেশি ব্যাংকগুলোতে কী হয়? যত বড় ঋণপ্রস্তাবই আসুক না কেন, সেগুলো মালিকদের কাছে যায় না। ঋণপ্রস্তাব বোর্ড মিটিংয়ে পাস হয় না। মালিকেরা শুধু ব্যাংকের পলিসি করতে পারেন যে, কোন খাতে কত বিনিয়োগ করা হবে। অথচ আমাদের মালিকেরা নিজেরাই ঋণ দেন। এই ক্ষমতা হাতে নিয়ে তাঁরা তাঁদের আপন লোকজন কিংবা ভুয়া লোকজনকে ঋণ দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, ব্যাংকার হলো পেশাগত মানুষ। তাঁরা গ্রাহকদের চেনেন। কিন্তু যিনি বোর্ডে বসেন, তাঁর সঙ্গে গ্রাহকের কোনো যোগাযোগ নেই। এ জন্য আমাদের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকের তুলনা করা যাবে না।

ব্যাংকের স্বার্থেই পরিচালনা পর্ষদে অংশীদারদের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। রাজনৈতিক একনায়কত্বে যেমন জনগণ অধিকার হারায়, তেমনি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ আমানতকারীরা সুযোগ ও আস্থা দুটোই হারাবেন। কেউ দীর্ঘদিন ক্ষমতার পদ ধরে থাকলে তাঁর মধ্যে কায়েমি স্বার্থ জন্ম নেয়। যেহেতু সেটা ক্ষমতার জায়গা, সেহেতু পছন্দের লোকের প্রতি তাঁর পক্ষপাত বাড়বে। মালিকপক্ষের এই ক্ষমতা ঠেকানোর মতো সুশাসন-কাঠামোও আমাদের নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অত্যন্ত দুর্বল। পৃথিবীতে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীন রাখা হয়, তাদের প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল, দক্ষতাও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। দক্ষতা না থাকলে যেমন ক্ষমতার প্রয়োগ হয় না, তেমনি ক্ষমতা না থাকলেও দক্ষতা প্রয়োগ করা যায় না। এ দুয়ের ভারসাম্য প্রয়োজন। এবারের বেলায় কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়ে তাদের দ্বিমত জানিয়েছিল। কিন্তু তাদের কথা শোনার দরকার মনে করা হয়নি। ব্যাংকিং খাতকে সঠিক লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতায়িত ও দক্ষ করতে হবে। এখন দেখছি তারা শুধু অভিযোগ করছে, কিন্তু ব্যবস্থা নিতে খুবই কুণ্ঠিত।

মন্ত্রিসভা নীতিগত সমর্থনটুকু দিয়েছে, এখনো এটা প্রস্তাবটা আইন আকারে পাস হয়নি। আমাদের প্রস্তাব থাকবে, এখন এটাকে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো যেতে পারে। দেখতে হবে সেই কমিটিকে যাতে প্রভাবিত করা না যায়। অথবা কোনো বিশেষ কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই এগোতে হবে।

ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্টের ৪৬ ধারায় বলা আছে, প্রাইভেট ব্যাংক যদি আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় বা খারাপ কাজে জড়িত হয়ে পড়ে, তবে ওই ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপসারণ করতে তো পারবেই, পুরো বোর্ডকেও অপসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু ওই পরিষদ যদি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হয়, তাহলে তা পারবে না। এটা কালো আইন, এক দেশে দুই ব্যবস্থা কেন? সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ব্যক্তি সাধারণত সরকারের লোক কিংবা সাবেক আমলা হয়ে থাকেন। তাঁদের সরানোর ব্যাপারে সরকারের দেমাগ কাজ করে। অবিলম্বে আইনের এই ধারার সংস্কার হওয়া দরকার।

মন্ত্রীসভায় যে নীতি পাশ হয়েছে আদর্শিক দিক থেকেও তা অগ্রহণযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল সব ক্ষেত্রে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধু চাননি এর উল্টোটা হোক। বঙ্গবন্ধুকন্যাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই নীতি রক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থার মতো গুরুতর ক্ষেত্রে সেই নীতির বরখেলাপ করা হলো। এটা মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক আদর্শেরও পরিপন্থী। পাকিস্তান আমলে ব্যাংকগুলো ছিল পরিবারভিত্তিক এবং ২২ পরিবারের হাতে। পাকিস্তানের ব্যাংকের যাবতীয় ধনসম্পদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। আমরা কি তাদের জায়গায় ৪০ ব্যাংকে ৪০ পরিবার সৃষ্টি করে তাদের ব্যাংকের সম্পদের ব্যবহারকারী করে দেব? এটা তো পেছনে যাওয়ার চেষ্টা।

ব্যাংক খাতে অনিয়মের জন্য আমি দায়ী করব অর্থ মন্ত্রণালয়কে। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও শাহ এ এম এস কিবরিয়া ব্যাংকব্যবস্থাকে সংযত রাখতে চেষ্টা করতেন। এখন সে রকম কিছু দেখাই যাচ্ছে না। অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক শক্তি তথা রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষণ এই ঘটনা। বর্তমান রাষ্ট্রপতি স্পিকার থাকাকালে বলেছিলেন, তিনি যে সংসদের স্পিকার সেই সংসদের শতকরা ৬২ ভাগ অত্যন্ত ধনী। অথচ একসময় উকিল সাহেব, অধ্যাপক সাহেব, ছোট ছোট ব্যবসায়ী সংসদে আসতেন। স্পিকার হিসেবে এটা তাঁর পর্যবেক্ষণ। এখন অনুপাতটা আরো অনেক বেড়েছে। সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে ততক্ষণ, যতক্ষণ সেখানে ধনীদের প্রভাব কম থাকবে। ভারতের ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে কম ঢোকেন। টাটা-বিড়লারা কিন্তু এমপি হতে যান না। আমাদের ধনীদের এমন সচেতনতা কম। আমাদের নব্যধনীরা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনৈতিক আদর্শকে আরও নষ্ট করে ফেলবে। টাকা-পয়সার মাদকতা আছে। সেই মাদকতা হলো নিয়ন্ত্রণের মাদকতা, একচেটিয়া ।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। (প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত)

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: