facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪

Walton

শীর্ষ খেলাপিদের থেকে ঋণ আদায় বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ শতাংশ


০৩ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার, ০৮:২৯  পিএম

স্টাফ রিপোর্টার

শেয়ার বিজনেস24.কম


শীর্ষ খেলাপিদের থেকে ঋণ আদায় বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ শতাংশ

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে মোট ১১৯.৩৮ কোটি টাকা আদায় করেছে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যা তাদের বার্ষিক ২,০৪৫ কোটি আদায় লক্ষ্যমাত্রার ৬ শতাংশেরও কম বলে তথ্যানুসারে জানা গেছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে– এই ছয় ঋণদাতা- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক (বিডিবিএল) ও বেসিক ব্যাংকের এসব খেলাপিদের কাছে মোট শ্রেণিকৃত ঋণ ছিল ২১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা।

এই তথ্য জানা যায়, গত অক্টোবরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সভায় উপস্থাপন করা প্রতিবেদন সূত্রে। প্রতিবেদনটির একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ছয় ব্যাংকের মধ্যে বছরের প্রথমার্ধে আদায়ের হার সবচেয়ে বাজে ছিল সোনালী ব্যাংকের। রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় এই বাণিজ্যিক ব্যাংকটি মোট ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে যৎসামান্য বা মাত্র ৩৮ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে তাদের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে। অথচ ব্যাংকটির বার্ষিক আদায় লক্ষ্যমাত্রা ৩০০ কোটি টাকা, যার তুলনায় প্রকৃত আদায় হয়েছে মাত্র ০.১৩ শতাংশ।

অপরদিকে, জানুয়ারি- জুন মেয়াদে নিজেদের শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের থেকে সবচেয়ে বেশি আদায়ের হার ছিল অগ্রণী ব্যাংকের। বার্ষিক ৩০০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে ৮৭ কোটি টাকা বা লক্ষ্যের ২৯ শতাংশ। সে তুলনায়, অগ্রণীর শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছে খেলাপি ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।

শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে সবচেয়ে বেশি বা ৮ হাজার ১০৯ কোটি টাকা পাওনা জনতা ব্যাংকের। বার্ষিক ৮০০ কোটি টাকা ঋণ আদায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকটি ঋণ আদায় করতে পেরেছে ১০ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ১.২৫ শতাংশ। বিডিবিএল বার্ষিক ১০ কোটি টাকা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ বা ২ কোটি টাকা আদায় করেছে।

অক্টোবরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বৈঠকে উপস্থিত থাকা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো টিবিএসকে জানিয়েছে যে, সভার আলোচনায় বলা হয়– রাষ্ট্রায়ত্ত সব কয়টি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে তাদের মোট শ্রেণিকৃত ঋণের সিংহভাগ রয়েছে। এদের কাছে থেকে আদায় হলে ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণ অনেক কমে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সংকটে রয়েছে।

"সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের এনটেক্স এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটেছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বেসিক ব্যাংকের অবস্থাও ভালো নয়। একের পর এক আর্থিক অনিয়ম ঘটেছে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকে। এসব কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির ঋণ পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় নেই।"

এমনকি সেপ্টেম্বর পর্যন্তও এসব ঋণ আদায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী মো. আফজাল করিম বলেন, "খেলাপি ঋণ আদায়ে ডিমান্ড লেটার ইস্যু করা, ঋণগ্রহীতাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগসহ আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছি। এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হলে– ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা করে থাকে। আমরা এই প্রক্রিয়ায় কাজ করি। কিন্তু, গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না।"

খেলাপি ঋণ আদায় প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, "আমরা শুধু শীর্ষ ২০ খেলাপির থেকে নয়, বরং সকল খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করি। নানান পদক্ষেপ নেওয়ায় আমাদের শ্রেণিকৃত ঋণ সেপ্টেম্বর মাসে জুনের চেয়ে কমেছে। আশা করছি, ডিসেম্বরে এটি আরও কমবে।"

অবলোপন করা ঋণ থেকেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।

চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংক তাদের ১ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১১.৪৭ শতাংশ বা ১৮২ কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করতে পেরেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি হওয়া মন্দ ঋণকে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিয়ে পৃথক হিসাবে রাখাই হচ্ছে অবলোপন। আলাদা হিসাবে রাখা হলেও অবলোপিত ঋণ আদায়ের কার্যক্রম চলমান রাখতে হয়। এতে ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে খেলাপির পরিমাণ কম দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়।

২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ অবলোপনের সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সভায় উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণের ৬৮৩ কোটি টাকার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ৬৯ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, ৩৪১ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জনতা ব্যাংক আদায় করেছে ৭০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৪০৫ কোটি টাকার বিপরীতে ৩৩ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৫৯ কোটি টাকার বিপরীতে ৪ কোটি, বিডিবিএল ১৫ কোটি টাকার বিপরীতে ৫ কোটি এবং বেসিক ব্যাংক ৮৪ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাত্র ১ কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করতে পেরেছে।

এই বছরের জুনের শেষপর্যন্ত, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মোট অবলোপনকৃত ঋণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকায়। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংকের ৬ হাজার ৭৭৬ কোটি, জনতার ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি, অগ্রণীর ৪ হাজার ১৮ কোটি, বিডিবিএলের ১ হাজার ৫০৭ কোটি, রূপালীর ৫৮৬ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে নগদ আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকের অর্জনই সন্তোষজনক নয়। এ ধরনের ঋণ থেকে নগদ আদায় করা খুব কষ্টকর হলেও- তা চৌকষভাবে আদায় করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঋণ আদায়ের হার বাড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া প্রতিবেদনটিতে।

চলতি বছর জনতা ব্যাংকের ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্য থাকলেও, প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি- জুন) আদায় করতে পেরেছে মাত্র ১০৫ কোটি টাকা। একই অবস্থা অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরও।

অর্থ বিভাগের সভার প্রতিবেদনটি অনুযায়ী, ১ হাজার কোটি টাকা আদায়ের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সোনালী ব্যাংক আদায় করতে পেরেছে ১৬৫ কোটি টাকা। একই পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের আদায় ২৪৮ কোটি টাকা।

২০০৭ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি টিবিএসকে বলেন, পুনঃশ্রেণিকৃত এবং অবলোপকৃত ঋণ, মামলায় আটকে থাকা ঋণ এসবই নন-পারফর্মিং লোনের অংশ। এর অর্থ– আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের হিসাবে যা দেখাচ্ছে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি।

সুশাসন ও দক্ষতার অভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতিও হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: