facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৯ মার্চ শুক্রবার, ২০২৪

Walton

যে প্রশিক্ষণে সবচেয়ে সফল হন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা


১২ আগস্ট ২০১৮ রবিবার, ০১:৩৪  পিএম

ডেস্ব রিপোর্ট


যে প্রশিক্ষণে সবচেয়ে সফল হন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা

শেয়ারবাজারের ইতিহাসে শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া কোনো মানুষ পাওয়া যায়নি, যাবেও না। পূর্বাভাস দিয়ে পুরো দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে দেয়া মানুষগুলোও হরহামেশাই ভুল প্রমাণিত হচ্ছেন। অন্যদিকে অর্বাচীন বিনিয়োগকারীও একবার মুনাফা করে, একবার লোকসান করে। প্রশ্ন করা যেতেই পারে, তাহলে এ দুইয়ের পার্থক্য থাকল কোথায়? উত্তরে শেয়ার বাছাই করা, বাজার পরিস্থিতি বোঝা, সময়মতো কেনা ও বেচার যোগ্যতা— এমন অনেক কিছুই উঠে আসবে। তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি সম্ভবত, অভিজ্ঞ ও সফলরা তাদের লোকসান নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন, যথাসময়েই ভুল শোধরাতে জানেন। কোন ভুলে কতটা মাশুল দিতে হয়, দেয়া যায়— তার হিসাব-নিকাশ ভালোমতো করেই তারা মাঠে নামেন। অন্যদিকে ছোট-বড় ভুলের অসীম মাশুল গুনতে গুনতে বাজার থেকে হারিয়ে যায় লাখ লাখ অর্বাচীন। লোকসান থেকে বাঁচার আকুতি তাদের এমন জায়গায় নিয়ে যায় যে, তারা শেয়ারবাজারের আসল আবেদনগুলোই ভুলতে বসে। শেয়ার কেনায় ভুলের মাশুল অর্থাৎ লোকসান সীমিতকরণ নিয়েই এ পর্বের মূল রচনা

শেষ পর্যন্ত টিকে থাকাই বিনিয়োগের মাঠে সবচেয়ে বড় লড়াই, যে বিদ্যা শেখা যেতে পারে জুডো ক্লাস থেকেও। মার্শাল আর্টটির প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি শেয়ারবাজারেও সমান প্রাসঙ্গিক। তা হলো ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ।

জুডো মাস্টাররা শুরুতেই অন্যকে কুপোকাত করার কৌশল শেখে না। তাদের বরং শেখানো হয় কীভাবে নিচে পড়তে হয়। কীভাবে পড়লে পরক্ষণেই আবার উঠে দাঁড়ানো যায়, কীভাবে পড়লে সেটি বিলম্বিত হয়, কীভাবে পড়লে উঠে দাঁড়ালেও আর লড়াইয়ে থাকা সম্ভব হয় না আর কীভাবে পড়লে উঠেই দাঁড়ানো যায় না— এগুলো শেখানো হয় জুডোর ক্লাসে। মাটিতে পড়ে যাওয়া আর নিঃশ্বাস নেয়া— দুটো যতদিন না একজন জুডো শিক্ষার্থীর কাছে একই রকমের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, ততদিন তাকে পড়ে পড়ে শুধু পতনের চর্চাই চালিয়ে যেতে হয়। জুডো ক্লাসে আপনি কতবার পড়ে গেলেন, তা কোনো ব্যাপারই না। প্রশিক্ষক বরং দেখেন কতবার আপনি উঠে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে গেলেন।

শেয়ারবাজারে সবচেয়ে সফল বিনিয়োগকারীরাও একই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যান, অন্তত মানসিক চর্চায়। তাদের অবশ্যই শিখতে হয়, কীভাবে লোকসানগুলো সীমিত রেখে বাজারে পরবর্তী সুযোগ কাজে লাগানো যায়। একটি শেয়ারে পূর্বনির্ধারিত সীমার বেশি লোকসান না করাই এর একমাত্র উপায়। সে সীমা নির্ধারণে বিনিয়োগকারীর দর্শন, কৌশল, আর্থিক সক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, বাজার পরিস্থিতি— এমন বহু বিষয় বিবেচ্য। স্ট্র্যাটেজিক শেয়ারহোল্ডিং আর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ভ্যালু ইনভেস্টমেন্টের বাইরে অন্য যেকোনো বিনিয়োগ কৌশলেই লোকসানের সর্বোচ্চ সীমা মেনে চলতে হয়।

বিশ্বব্যাপী দেখা যায়, বিনিয়োগকারীরা তাদের সম্ভাব্য মুনাফার সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক। অন্যদিকে নিছক মূলধনি মুনাফার জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পজিশনগুলোয় তারা আরো কম ঝুঁকি নেন। অর্থাৎ একটি শেয়ারে ২০-৩০ শতাংশ মুনাফা আশা করলে, সেখানে ৭-১০ শতাংশের বেশি ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ নেই। ১০০ শতাংশ মুনাফা আশা করলে ৩৩ শতাংশের বেশি লোকসান করা যাবে না। তবে ১০০০ শতাংশ মুনাফার অপেক্ষায় ৩৩০ শতাংশ পর্যন্ত লোকসানের সুযোগ গণিত আমাদের দেয়নি। ড্র ডাউন অ্যান্ড রিকভারি টেবিলের দিকে চোখ বুলালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমরা বুঝে যাব, লোকসান করা যত সহজ, মুনাফা করে তা পুনরুদ্ধার করা চিরকালই তার চেয়ে কঠিন।

 

ড্র ডাউন টেবিল অ্যান্ড রিকভারি: বিনিয়োগে লোকসানের গণিত

ধরুন ৬৫ টাকায় বিক্রির আশায় আপনি ৫০ টাকায় একটি শেয়ার কিনেছেন। কয়েক দিনের মাথায় এটি ৮ শতাংশ কমে ৪৬ টাকায় নেমে এল। আপনি মনে করছেন, এর দাম আরো কমে যেতে পারে। তাই শেয়ারটি বেচে বেরিয়ে এলেন। এ ৮ শতাংশ লোকসান পুষিয়ে নিতে আপনাকে এখন ৮ শতাংশ মুনাফা করলে হবে না। ৪৬ টাকার ওপর আপনাকে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ মুনাফা করে পুঁজি আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। পরপর এমন তিনবার লোকসান করলে আপনার প্রারম্ভিক পুঁজি ২৫-৩০ শতাংশের মতো কমবে, চতুর্থ প্রচেষ্টায় সফল হলেই যা পুনরুদ্ধার সম্ভব। এছাড়া প্রথমবারে আপনি বেচে দেয়ার পর শেয়ারটির দর বাড়তে শুরু করলে তখনো সেখানে আবার ক্রয়াদেশ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এক দফায় ৮ শতাংশ লোকসান করার পর শেয়ারটি আবার কেনার সময় হয়তো আপনার খরচ কিছুটা বেশি হয়েছে। কিন্তু প্রথমবারের লোকসানটি ৮ শতাংশের বদলে ১৬ শতাংশ বা ২৫ শতাংশে ঠেকলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো। কারণ আপনি তিনবার জিতে মোট ৭০ শতাংশের বেশি মুনাফা করার চেষ্টাই করতে পারতেন না।

গণিত বলে, ২৫ শতাংশ লোকসান পোষাতে আপনাকে ৩৩ শতাংশ মুনাফা করতে হবে আর ৪০ শতাংশ কমে গেলে করতে হবে ৬৭ শতাংশ। বাজারমূল্য আপনার কেনা দামের অর্ধেকে নেমে এলে তা পুষিয়ে নিতে পরের দফায় আপনার রিটার্ন ১০০ শতাংশ হতেই হবে। এখন নিজেকে প্রশ্ন করুন, গত কয়েক বছরে আপনি কতটি শেয়ার থেকে ১০০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি হারে মূলধনি মুনাফা পেয়েছেন?

কেনার পর লোকসান ৮০ শতাংশ হলে আপনার শেয়ারটির দাম বিক্রির সময়কার অবস্থান থেকে চার গুণ হতে হবে। এছাড়া লোকসান ৯৯ শতাংশ হলে ৯ হাজার ৯০০ শতাংশ মুনাফা করে তা পোষাতে হবে। আর লোকসান ১০০ শতাংশে ঠেকার অর্থ হলো, শেয়ারবাজারে আপনার আর কোনো পুঁজিই অবশিষ্ট রইল না। অর্থাৎ বাজার আপনাকে ‘গুড বাই’ বলে দিয়েছে।

স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, লোকসান যত সীমিত করা যায়, ঘুরে দাঁড়িয়ে পরের সুযোগটি কাজে লাগানোর সম্ভাবনাও তত জিইয়ে রাখা যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এ নিয়ম মেনে না চললে আপনি শেয়ারবাজারে পরবর্তী মুনাফাগুলো ধরার জন্য টিকে নাও থাকতে পারেন।

 

তবুও মানুষ লোকসান বাড়তে দেয়, মুনাফা নয়

ওয়াল স্ট্রিটের সবচেয়ে টেকসই শিক্ষাগুলোর একটি ‘কাট ইওর লসেস শর্ট অ্যান্ড লেট ইওর উইনারস রান’। বিচক্ষণ এ শিক্ষার সুফল শত বছর ধরে দেখিয়ে যাচ্ছেন সফল বিনিয়োগকারী ও ট্রেডাররা। তার পরও বেশির ভাগ মানুষ ঠিক উল্টোটাই করে। মুনাফা হচ্ছে দেখলে, তা হারানোর ভয় তাকে ঘিরে ধরে এবং অল্প মুনাফা নিয়েই সে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এর পর তাকিয়ে তাকিয়ে দরবৃদ্ধির বাকি গল্পটি দেখে। অন্যদিকে কিছু লোকসান গোনা শেয়ারগুলো আরো জোরে আঁকড়ে ধরে এবং নিজের অজান্তেই লোকসান আরো বড় হওয়ার অপেক্ষা করে। সাধারণ মানুষ এমনটি করে তার কিছু আবেগীয় বাস্তবতার বশে। এটি কখনই তার সুচিন্তিত ও পরীক্ষিত বিনিয়োগ কৌশলের অংশ নয়।

এটুকু পর্যন্ত পড়ে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের কী করতে হবে।

করণীয়টি খুব সহজ শোনালেও বহু বিনিয়োগকারী সতর্কভাবে গবেষকদের জানিয়েছেন, শেয়ার কেনাবেচায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটির যথাযথ প্রয়োগ কত কঠিন। গবেষকরা বলেন, লোকসান বুঝে নেয়ার জন্য কেউই শেয়ার বেচতে চায় না। বিনিয়োগকারী বিশ্বাস করে, দাম এখন কম আছে বলে পোর্টফোলিওতে লোকসান দেখাচ্ছে। না বেচলেই হলো। শেয়ারটি ধরে রেখে ‘আপাত দুঃসময়’টি সামলে পরে একসময় মুনাফার চেষ্টা করাই ভালো । এছাড়া আবেগ তাকে বলে, লোকসানে বেচে দেয়ার অর্থই হলো, আপনি মেনে নিয়েছেন যে, আপনি একটি ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারচেয়ে ভুলটি নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। লোকসানের শেয়ারটি পোর্টফোলিওর ফোঁড়া বা টিউমার থেকে ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার আগে তিনি আর এ নিয়ে ভাবতে রাজি নন। আশা তাকে বলে, শেয়ারটির দর আজ হোক, কাল হোক বাড়বেই। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নির্ধারিত সীমার নিচে নেমে গেলে বাজারে সিংহভাগ শেয়ারের দামই আরো কমতে শুরু করে। তাই লোকসান ক্রমে বড় হতে দেখলেও কোনো অ্যাকশনে না যাওয়া পোর্টফোলিওর জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আবার কমতে কমতে দরবৃদ্ধি শুরুর ঠিক আগের পয়েন্টগুলোয় হতাশ হয়ে বিক্রি করে দেয়াও বিনিয়োগকারীর দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের আগাম বার্তা দেয়।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

শেয়ার বিজনেস কী? -এর সর্বশেষ