facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

জালিয়াতি করে ইউসিবি ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ


১০ মে ২০২২ মঙ্গলবার, ১০:০৭  পিএম

স্টাফ রিপোর্টার

শেয়ার বিজনেস24.কম


জালিয়াতি করে ইউসিবি ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) একটি প্রকল্পের কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) নিয়ে জাল নথিপত্রের মাধ্যমে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবি) থেকে ঋণের নামে ৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন ঠিকাদার ও ব্যাংক কর্মকর্তা মিলেমিশে অভিনব কৌশলে এমন জালিয়াতি করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বিষয়টির প্রমাণ মিলেছে। চসিকের প্রকল্প কাজে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রমাণও পাওয়া গেছে।

জালিয়াতির ওই ঘটনায় অনুসন্ধান কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে দুদকের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। যেখানে বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবি) পাঁচ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তিন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ মোট আটজনকে আসামি করা হয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদক উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল হক বাদী হয়ে মামলাগুলো দায়ের করেন।

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (পরিচালক) নাম প্রকাশ না করে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি প্রকল্প কাজের কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) নিয়ে জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছে। যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তা, মূল ঠিকাদার, সাব-কন্ট্রাক্টরসহ কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

জালিয়াতির ওই ঘটনায় অনুসন্ধান কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে দুদকের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। যেখানে বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবি) পাঁচ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তিন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ মোট আটজনকে আসামি করা হয়েছে
‘দুদকের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হলেও তার বিপরীতে নামমাত্র সম্পত্তি বন্ধক (মর্টগেজ) রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে ঋণের টাকা পরিশোধ না করে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। কমিশন থেকে এ বিষয়ে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে’— বলেন ওই কর্মকর্তা।

মামলায় আসামি করা হয়েছে সাব-কন্ট্রাক্টর ও মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জাকির হোসেন, মূল ঠিকাদার মেসার্স রানা বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক মোহাম্মদ আলম, মেসার্স এস এ ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক সালেহ আহমেদ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ফাস্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যাংকটির কুমিল্লা শাখার সাবেক হেড অব ব্রাঞ্চ মোহাম্মদ সারোয়ার আলম, অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিসুজ্জামান, ফাস্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইফুল আলম মজুমদার, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মাহমুদুল ইসলাম আরেফিন এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার দেবু বোশকে।

অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব পোর্ট কানেক্টিং রোড’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৫০ কোটি ৮৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৩ টাকা সর্বনিম্ন দরদাতা রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)-কে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ আলম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এরপর মোহাম্মদ আলম দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এক হাজার টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আমমোক্তারনামার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কাজটি বাস্তবায়নের জন্য মো. জাকির হোসেনকে আমমোক্তার নিয়োগ করেন। জাকির হোসেন ওই আমমোক্তারনামা ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয়ে ‘রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)’- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে ইউসিবিএলের কুমিল্লা শাখায় হিসাব খোলেন। আমমোক্তারনামা, মিথ্যা পরিচয় ও স্বাক্ষর যাচাই না করেই ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে সহায়তা করেন।

৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হলেও তার বিপরীতে নামমাত্র সম্পত্তি বন্ধক (মর্টগেজ) রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে ঋণের টাকা পরিশোধ না করে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। কমিশন থেকে এ বিষয়ে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক পরিচালক

দুদকের অনুসন্ধানে ব্যাংকটির অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিসুজ্জামান ও তৎকালীন হেড অব ব্রাঞ্চ মোহাম্মদ সরোয়ার আলমের অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া মো. জাকির হোসেন একই নথিপত্র ব্যবহার করে নিজ প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের নামে আরও একটি লোন হিসাব খোলেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, জাকির হোসেন রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি) নামীয় ওই কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ আবেদন করলে ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইউসিবিএল থেকে ৯০ দিনের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। যা পরবর্তীতে ২০ মাসের মেয়াদে ঋণসীমা ১২ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে মোট ২০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করিয়ে নেন জাকির হোসেন।

অনুরূপভাবে মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের নামেও একই প্রক্রিয়ায় অন্য হিসাবে আরও ২০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। যে কারণে পৃথক আরও একটি মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়।

মোট ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হলেও বিপরীতে জাকির হোসেন সামান্য সম্পত্তি বন্ধক (মর্টগেজ) রাখেন। যার মধ্যে রয়েছে- কুমিল্লায় ৩ শতক জমির ওপর পাঁচতলা ভবন, যার বাজারমূল্য ১.৯০ কোটি টাকা। এছাড়া বুড়িচং উপজেলার শরীয়তপুর মৈাজার ৮১ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য ০.৬০ কোটি টাকা; বুড়িচং উপজেলার উত্তর বিজয়পুর মৈাজার ২৫ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য ০.৮৮ কোটি টাকা; কুমিল্লা শহরে ১৩ শতক ও ১২৩৫ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, যার বাজারমূল্য ১.৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট চার কোটি ৯৬ লাখ টাকার সম্পত্তি বন্ধক রাখেন জাকির হোসেন।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, মিথ্যা পরিচয়ে নামমাত্র সম্পত্তি বন্ধক রাখার মাধ্যমে মো. জাকির হোসেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের কুমিল্লা শাখা থেকে ২০ কোটি টাকা অবৈধভাবে ঋণ গ্রহণ করেন এবং আত্মসাৎ করেন। যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তারা সরাসরি সহযোগিতা করেন তাকে।

দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য একাধিকবার সময় বাড়ানোর পরও ঠিকাদার কাজটি সিডিউল অনুযায়ী শেষ না করায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কার্যাদেশ বাতিলের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)-কে ২৮ দিনের নোটিশ দেয়। পরবর্তীতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে এক বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করাসহ কার্যাদেশ বাতিল ও যৌথ পরিমাপের জন্য চিঠি পাঠায়।

মোট ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড়া করা হলেও বিপরীতে জাকির হোসেন সামান্য সম্পত্তি বন্ধক (মর্টগেজ) রাখেন। যার মধ্যে রয়েছে- কুমিল্লায় ৩ শতক জমির ওপর পাঁচতলা ভবন, যার বাজারমূল্য ১.৯০ কোটি টাকা। এছাড়া বুড়িচং উপজেলার শরীয়তপুর মৈাজার ৮১ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য ০.৬০ কোটি টাকা; বুড়িচং উপজেলার উত্তর বিজয়পুর মৈাজার ২৫ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য ০.৮৮ কোটি টাকা; কুমিল্লা শহরে ১৩ শতক ও ১২৩৫ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, যার বাজারমূল্য ১.৫৮ কোটি টাকা

২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জাইকার কনসালটেন্ট ও এলজিইডির প্রকৌশলীদের উপস্থিতিতে যৌথভাবে প্রকল্পটির কাজ সরেজমিনে পরিমাপ করা হয়। পরিমাপের পর মোট ৩৫ কোটি এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৭ টাকার কাজ পাওয়া যায়। অবশিষ্ট ১৫ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার ৯১৬ টাকার কাজ শেষ করার জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে ২০ কোটি নয় লাখ ৩৬ হাজার ১০৫ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। নতুন দরপত্র অনুযায়ী দুই কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায়।

দায়ী ব্যক্তিদের বিবরণের বিষয়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিকাদার মোহাম্মদ আলম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্পের কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে চুক্তিপত্র বা দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছেন এবং মো. জাকির হোসেনকে অবৈধভাবে কাজ বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক দায়দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন। যেখানে চুক্তিপত্র অনুযায়ী কাজটি সম্পাদন না করে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখে চরম গণভোগান্তি সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি সরকারের দুই কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন।

অন্যদিকে, মো. জাকির হোসেন অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে অবৈধভাবে আমমোক্তার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর দিয়ে ইউসিবিএল, কুমিল্লা শাখায় হিসাব খুলে ২০ কোটি টাকা এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ২০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। সুদের আংশিক পরিশোধ করলেও মূল টাকা পরিশোধ না করে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সরোয়ার আলম, মো. আনিসুজ্জামান, সাইফুল আলম মজুমদার, মাহমুদুল ইসলাম ও দেবু বোশ লাভবান হওয়ার জন্য অবৈধ আমমোক্তারনামা, মিথ্যা পরিচয় ও স্বাক্ষর যাচাই বা নিশ্চিত না হয়েই ব্যাংকের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে হিসাব খোলেন এবং অপর্যাপ্ত সম্পদ বন্ধক (মর্টগেজ) রেখে মোট ৪০ কোটি টাকার ঋণ দেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪২০/১০৯ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে— উল্লেখ করা হয় দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: