ঢাকা   রোববার ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

ফ্যামিলিটেক্সের কারখানা নিলামে: প্রতারক পরিচালকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে 

শেয়ারবাজার

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:২০, ২০ জুলাই ২০২৫

ফ্যামিলিটেক্সের কারখানা নিলামে: প্রতারক পরিচালকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে 

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত টেক্সটাইল কোম্পানি ফ্যামিলিটেক্স (বিডি) লিমিটেড-এর বিরুদ্ধে কড়াকড়ি পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। দীর্ঘদিনের বকেয়া ভাড়ার দায়ে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত কারখানা, ভবন, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিলামে বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে বেপজা।

গত ৩০ জুন দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগ্রহী বিডারদের আগামী ৬ আগস্টের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে হবে। যারা কারখানা চালু রেখে পরিচালনা করতে চান, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

এই কারখানাটি প্লট নম্বর ৪৭-৪৮-এ অবস্থিত এবং এটি ৩০ বছরের জন্য ইজারা নেওয়া হয়েছিল, যা ২০৩৪ সালের ৮ জুলাই পর্যন্ত বৈধ। কিন্তু চুক্তির শর্তভঙ্গ ও ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে বেপজা ইতোমধ্যে লিজ বাতিল করেছে।

এর আগেও ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম দফায় নিলাম আহ্বান করেছিল বেপজা, তবে সাড়া না পাওয়ায় এবার দ্বিতীয় দফার নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

শুধু বেপজাই নয়, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকও ২০২৩ সালের জুনে ৪৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রির উদ্যোগ নেয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ ২০১৪ সালে তিনটি জমি ও একটি ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন, যা এখনো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করা এই গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালে আইপিওর মাধ্যমে ৩৪ কোটি টাকা তুলেছিল, যা মূলত উচ্চ সুদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহারের কথা ছিল। প্রথম বছর ১০০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দিলেও, এরপর থেকেই ব্যবসায়িক ধস শুরু হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিক লোকসানে চলছে।

২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিয়েই গায়েব হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালে ডিএসই’র প্রতিনিধি দল কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে কারখানা ও অফিস উভয়ই বন্ধ অবস্থায় দেখতে পায়। এরপর বিএসইসি নতুন পাঁচজন স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করে, কিন্তু স্পন্সরদের অসহযোগিতার কারণে পরিচালকরা নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হন। পরে তারাও পদত্যাগ করেন।

শুধু তাই নয়, তদন্তে উঠে আসে ভয়াবহ অনিয়মের তথ্য। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঘোষণা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা ৪১% শেয়ার বিক্রি করে দেন। আইপিওর সময় স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে ৪৫.১৬% শেয়ার থাকলেও, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তা নেমে আসে মাত্র ৪.০২ শতাংশে।

শেয়ার বিক্রি কেলেঙ্কারিতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, পরিচালক ও কোরিয়ান স্পন্সরও জড়িত ছিলেন। কোরিয়ান স্পন্সর জুন কিউং উন ২০১৫ সালে ৪ কোটি ১৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করেন। পরে চেয়ারম্যান রোকসানা মোরশেদ ও পরিচালক মেরাজ-ই-মোস্তফাও দেড় কোটি শেয়ার বিক্রি করেন। অথচ এত বড় অনিয়মের পরও বিএসইসি এতদিন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোহাম্মদ মোরশেদ বিদেশে পলাতক, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পড়ে আছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩৫৪ কোটি টাকা এবং মোট শেয়ারের সংখ্যা ৩৫ কোটি ৪১ লাখ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৮.৪১% এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৭৭.৫৭% শেয়ার। আজ ২০ জুলাই, রোববার সকাল ১০টা ১৩ মিনিটে ডিএসইতে প্রতিটি শেয়ারের দর ছিল মাত্র ২ টাকা ৩০ পয়সা।

ফ্যামিলিটেক্স এখন পুঁজিবাজারের এক ব্যর্থতার প্রতীক, যেখানে অসহায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি আজ হারানোর পথে, আর প্রতারক পরিচালকেরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।