facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪

Walton

সাজার আওতার বাইরে সালিস-ফতোয়ার কর্তারা


০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার, ১১:৩৮  এএম

নিজস্ব প্রতিবেদক


সাজার আওতার বাইরে সালিস-ফতোয়ার কর্তারা

উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া এবং অবৈধ সালিসের ঘটনা থামছে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, গত বছর (২০১৭) সালিস ও অবমাননাকর ফতোয়ার ঘটনায় ১০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু অবৈধ সামাজিক বিচারকর্তাদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। এর বাইরে ফতোয়া-সংক্রান্ত আলোচিত তিনটি মামলার আসামিরা এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আসেনি।

২০১১ সালের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী, ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তি ফতোয়া দিতে পারবেন, যা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বল প্রয়োগ বা অন্যান্য প্রভাব ব্যবহার করা যাবে না। দেশের প্রচলিত আইনে বিধান আছে, এমন বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে কারও অধিকার, খ্যাতি বা সম্মানহানি করা যাবে না। এর মাধ্যমে কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক শাস্তিও দেওয়া যাবে না।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বিরোধ নিয়ে সালিসের প্রক্রিয়া এবং ফলাফল আইনের পরিপন্থী না হলে তাকে বৈধ বলা হবে। সালিসে মধ্যস্থতা করা গেলেও সাজা দেওয়ার নিয়ম নেই। আর ধর্ষণসহ গুরুতর অপরাধে সালিসের কোনো নিয়ম নেই।

আসকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হিসাবে ১৩৫ জন নারী সালিস ও ফতোয়ার কারণে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এসব ঘটনায় মামলা হয় মাত্র ৪১টি। হত্যার শিকার হন ২ জন। আত্মহত্যা করেন ১৬ নারী। আপিল বিভাগের রায়ের পর ফতোয়ার জন্য এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়নি। আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে গ্রামছাড়া, সমাজচ্যুত বা একঘরে করা হয় তিন নারীকে। হিল্লা বিয়ে ও দোররার শিকার হন তিনজন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন চার নারী। তাঁদের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়, আরেকজন আত্মহত্যা করেন।

সেসব ঘটনা

গত ১৪ ডিসেম্বর (২০১৭) ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে পরকীয়ার অভিযোগে এক গৃহবধূর বিচারের জন্য আয়োজিত সালিসে স্থানীয় কাজি মো. কালাম তাঁকে তওবা পড়ান। সালিসে দোররা মারার বিষয়টিও আলোচিত হয়। পরে ওই গৃহবধূ ২১ ডিসেম্বর স্বামীর বাড়িতেই আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলায় কাজি আটক হন।

এ ছাড়া গত ডিসেম্বরের শুরুতে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ ইউনিয়নের কল্যাণপুর জামে মসজিদের মাইক থেকে ‘ফসলের ক্ষতি’ ও ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’-এর অজুহাতে নারীদের মাঠে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিপ্লব কান্তি সরদার প্রথম আলোকে বলেন, কল্যাণপুর জামে মসজিদের পেশ ইমাম আবু মুছাসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আলোচিত তিন মামলা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফতোয়া-সংক্রান্ত আলোচিত তিনটি মামলায় আসামিরা এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আসেনি। একটি মামলার আসামি বর্তমানে ইউপি সদস্য।

তিনটি মামলার একটি হলো ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর নওগাঁ সদরের কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামের এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে দিতে বাধ্য করার ঘটনা। এ ঘটনায় নওগাঁ পুলিশ বাদী হয়ে ফতোয়া দেওয়া মাওলানা আজিজুল হকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের ৩ জানুয়ারি মামলা করেন। বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০০৮ সালের ২০ জানুয়ারি নওগাঁর অতিরিক্ত জজ আদালত-১ সব আসামিকে খালাস দেন। বর্তমানে ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামী গ্রামেই আছেন। তাঁরা এখন এ বিষয়ে কথা বলতে চান না। আজিজুল হক ২০১৪ সালে মারা যান।

আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের ১৪ বছরের কিশোরী হেনাকে ধর্ষণ করে তার চাচাতো ভাই মাহাবুব (৪০)। এ ঘটনায় মাহাবুবের স্ত্রী ও ভাই উল্টো হেনাকে মারধর করে। চামটা ইউপির তৎকালীন সদস্য ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে সালিসে মাহবুব ও হেনাকে দোররা মারার রায় দেওয়া হয়। দোররা মারার পর হেনা অচেতন হয়ে পড়ে। পরে হাসপাতালে মারা যায়। শরীয়তপুর জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মির্জা হজরত আলী বলেন, হেনার মামলাটি এখন পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি। মামলাটি এক বছর ধরে সাক্ষীর অপেক্ষায় আছে। আসামিরা জামিনে আছে।

হেনার ঘটনায় দুই মামলায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন রওশন আরা বেগম। তিনি বলেন, হেনার মামলাসহ বিভিন্ন ফতোয়ার মামলা দ্রুত বিচার আইনের আওতায় আনা জরুরি। মামলার দীর্ঘসূত্রতায় সাক্ষীরা একসময় আর সাক্ষ্য দিতে চান না। আসামিপক্ষের সঙ্গে জোট বাঁধে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নওগাঁর রানীনগরে এক গৃহবধূ ও তাঁর স্বামীর বন্ধুকে ১০১টি দোররা মারার ঘটনা ঘটে। ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, ওই গৃহবধূর স্বামীর বন্ধু স্বামীর অনুপস্থিতিতে ঘরে গেলে দুজনের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তোলেন গ্রামের মাতবর আফজল হোসেন। ২০১২ সালের এ মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলার এক আসামি আজিজুল ইসলাম বর্তমানে ইউপি সদস্য। তবে ২০১৪ সালে উভয় পক্ষের আপস মীমাংসায় মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে।

(কুষ্টিয়া, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, আদমদীঘি (বগুড়া), শরীয়তপুর প্রতিনিধির সহায়তায় প্রতিবেদনটি তৈরি)-প্রথম আলো

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: