facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৯ মার্চ শুক্রবার, ২০২৪

Walton

ভয়াবহ তথ্য গোপন করে হাজার কোটি টাকা লোপাট কেপিসিএলের


১৯ নভেম্বর ২০১৮ সোমবার, ১০:৫৫  পিএম

নিজস্ব প্রতিবেদক


ভয়াবহ তথ্য গোপন করে হাজার কোটি টাকা লোপাট কেপিসিএলের

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) বিরুদ্ধে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে লুকোচুরির অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটির ১১০ মেগাওয়াটক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গুরুতর এই তথ্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়নি তারা। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেও এই তথ্য আড়াল করে রাখা হয়েছে। অসৎ কোনো উদ্দেশ্যেই এই তথ্য গোপন রাখা হয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে আলোচিত প্ল্যান্টটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেপিসিএলের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৪২ শতাংশ কমে গেছে। কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৬৫ মেগাওয়াট থেকে ১৫৫ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।

অভিযোগ রয়েছে, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আড়াল করে রেখে কোম্পানিটির একাধিক উদ্যোক্তা গত দুই মাসে চড়া দামে তাদের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে কোম্পানির ওই নেতিবাচক খবরটি সম্পর্কে অন্ধকারে থাকা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত এক মাসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ কমে ১২০ টাকা থেকে ৯০ টাকায় নেমে এসেছে।

কোম্পানিটির দুই উদ্যোক্তা সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে কারসাজির মাধ্যমে চড়া দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। সরাসরি তালিকাভুক্তি নামের বিতর্কিত পদ্ধতিতে ২০১০ সালে বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি।

তালিকাভুক্তির আগের বছরে অর্থাৎ ২০০৯ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ছিল মাত্র ২ টাকা ৭৯ পয়সা। অথচ বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে এমন মাঝারি ইপিএসের এই কোম্পানির নির্দেশক মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৬২ টাকা। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে কোম্পানিটির দুই উদ্যোক্তা তাদের বেশির ভাগ শেয়ার ৩০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করেন। সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপ মিলে ৫ কোটি ২১ লাখ ৪৮ হাজার ২৫০টি শেয়ার বিক্রি করে। গড়ে ৩০০ টাকা দাম ধরা হলেও মাত্র ৫২ কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেট থেকে ১ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা নিয়ে যায় তারা। ওই সময় কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সামিট গ্রুপের কর্ণধার মুহাম্মদ আজিজ খান। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের কর্ণধার মোঃ হাসান মাহমুদ রাজা।

একই চক্র ও একই কোম্পানি আবারও বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কৌশলে কোম্পানির অতি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যসংবেদনশীল তথ্য আড়াল করে নিজেরা ফায়দা নিয়েছে।

জানা গেছে, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল প্ল্যান্টটির (ইউনিট-১ হিসেবে পরিচিত) বিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তির মেয়াদ গত ১২ অক্টোবর শেষ হয়ে গিয়েছে। ওই চুক্তি অনুসারে কেপিসিএলের উৎপাদিত পুরো বিদ্যুৎ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) তথা সরকার কিনে নিয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করত। গত ১২ অক্টোবর বিপিডিবি ও কেপিসিএলের মধ্যকার ৫ বছর মেয়াদী চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

কোম্পানিটি অবশ্য চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি’র কাছে আবেদন করেছে। আবেদনে ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জায়গায় ১৫০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্ট প্রতিস্থাপন করার অনুমতি এবং ওই কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নেওয়া প্রস্তাব করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ওই আবেদনের কোনো অগ্রগতি নেই বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার নতুন করে এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে রাজি নয় বলে জানিয়েছে সূত্র। তাছাড়া খুলনা পাওয়ার কোম্পানি যে অঞ্চলে (খুলনা) অবস্থিত সেই একই অঞ্চলে নির্মিত হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৩শ মেগাওয়াট। আগামী দুই বছরের মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই কেন্দ্র থেকে সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনার মুখে সরকার বেসরকারি কেপিসিএল থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার ঝামেলায় যাবে কি-না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে।

জানা গেছে, বিপিডিবির সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কেপিসিএল তার ইউনিট-১ গত ১২ অক্টোবর থেকে বন্ধ রেখেছে। কারণ ইউনিট চালু রাখা হলেও উৎপাদিত বিদ্যুৎ অবিক্রিত থেকে যাবে। আইন অনুসারে, সরকারের অনুমতি ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রি করা যায় না।

আইন অনুসারে, যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন পার হয়ে গেলেও ওই তথ্য তাদের জানায়নি। এটি আইনের গুরুতর লংঘন।

এদিকে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আড়ালের বিষয়টি সম্পর্কে বিএসইসির ভাষ্য জানতে চাইলে রোববার তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নজরে আসে। এর প্রেক্ষিতে ওইদিনই জরুরিভাবে ডেকে পাঠানো হয় কেপিসিএলের কোম্পানি সচিব ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. সোহরাব আলী খানকে। তবে বিএসইসি তাকে কী নির্দেশনা দিয়েছে তা জানা যায়নি।

কেপিসিএলের কোম্পানি সচিব ও অর্থকর্মকর্তা মো. সোহরাব আলী খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কেপিসিএল ইউনিট-১ এর বিদ্যুৎ বিক্রি সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে গোপন করেছেন কেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিপিডিবির সঙ্গে খুলনা পাওয়ারের চুক্তি নবায়নের বিষয়টি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাই বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়নি।

তিনি বলেন, তারা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

কেপিসিএল ইউনিট-১ এর উৎপাদন বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হলে তা ডিএসই এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানিয়েছেন কি-না সে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

খুলনা পাওয়ারের এ কাজ সম্পর্কে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাছাড়া তথ্য গোপন করে কমপ্লায়েন্স পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিএসইসির নির্দেশনা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন তারা।

তিনি আরো বলেন, কয়েকদিন আগে খুলনা পাওয়ারের শেয়ার বেচাকেনা নিয়ে অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় লেনদেন স্থগিত করে দিয়েছিল ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ। যদিও পরে তা শর্ত সাপেক্ষে চালু করা হয়েছে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো কোম্পানিও যদি আইন লঙ্ঘন করে তাহলেও একইভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করবে ডিএসই।

ডিএসই ব্রোকারর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) সভাপতি মোশতাক আহমেদ সাদেক অর্থসূচককে বলেন,খুলনা পাওয়ারের একটি ইউনিটের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমিও শুনেছি। তবে এ বিষয়ে কিছুই বলার নেই।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমার জানামতে খুলনা পাওয়ারের বিষয়ে কিছুদিন পূর্বে ডিএসই একটা ব্যবস্থা নিয়েছিল।পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বিএসইসি। তাই বর্তমানে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করারই ভালো। আশা করছি কোম্পানিটি সত্যিই এমন কোনো অনিয়ম করে থাকলে বিএসইসি ভালোভাবে খতিয়ে দেখে সঠিক ব্যবস্থা নেবে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো: সাইফুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে খুলনা পাওয়ারের চুক্তি নবায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন হলে কোনো সমস্যা নেই। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলে বা কোনো তথ্য গোপন করছে কি না কমিশন সেগুলো দেখবে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই আইনের লংঘন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের তথ্যটি জানানোর দরকার ছিল। প্রয়োজনে মেয়াদ বাড়ানোর আবদনের বিষয়টিও জানাতে পারতো তারা। কিন্তু কোনো তথ্যই প্রকাশ না করে গুরুতর অপরাধ করেছে কোম্পানিটি। কমিশন নিশ্চয়ই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।

খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড হচ্ছে দেশের প্রথম বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি। কোম্পানিটি ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই বিপিডিবির সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদী বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হয়। এর প্রথম প্লান্টটি (কেপিসিএল ইউনিট-১) খুলনার গোয়ালপাড়ায় নদীতে ভাসমান বার্জের উপর অবস্থিত। বার্জ মাউন্টেন্ট নামের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা ১১০ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে প্রথম চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হলে ৫ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়, যা ওই বছরের ১৩ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। এ বছরের ১২ অক্টোবর চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হলে মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।

কোম্পানিটির আরও দুটি প্ল্যান্ট রয়েছে। এর মধ্যে কেপিসিএল ইউনিট-২ খুলনায় অবস্থিত। স্থলভাগে অবস্থিত এই কেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা ১১৫ মেগাওয়াট। অন্য প্লান্টটি হচ্ছে খানজাহান আলী পাওয়ার কোম্পানি। এই প্ল্যান্টটি যশোরের নোয়াপাড়ায় অবস্থিত যার উৎপাদনক্ষমতা ৪০ মেগাওয়াট।

আলোচিত দুটি প্ল্যান্টই হচ্ছে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। প্ল্যান্ট দুটির উৎপাদিত বিদ্যুত কেনা-বেচার ব্যাপারে বিপিডিবির সঙ্গে কোম্পানিটির ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি রয়েছে। বিদ্যমান চুক্তিটির মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত। 

 

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: