facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

ভুল হিসাবে ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক!


১৯ অক্টোবর ২০১৭ বৃহস্পতিবার, ০১:৫৮  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


ভুল হিসাবে ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক!

শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কত, সে হিসাব কষতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ভুল করছে বলে অভিযোগ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। তাদের দাবি, এই ভুল হিসাবের ভিত্তিতে সাত বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যেককে ১৭ লাখ থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা করে আর্থিক জরিমানা দিতে হয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংককে একই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক জরিমানা করতে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ করেছেন।

যেসব ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে, তাদের অন্যতম হলো- মিউচুয়াল ট্রাস্ট, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী, দি সিটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ইত্যাদি। আরও চারটি ব্যাংককে একই কারণে জরিমানা করা হয়েছে বলে কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর কারণে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ কমাচ্ছে বলে সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন। বিশেষায়িত ব্যাংক বিডিবিএল জানিয়েছে, গত তিন সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটি একাই প্রায় সোয়াশ` কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। অন্য অনেক ব্যাংকও এভাবে শেয়ার বিক্রি করেছে। এ কারণে দুই সপ্তাহ ধরে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্রমাগত কমছে শেয়ারদর। বাজার সূচকের পতন হয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। লেনদেন নেমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশে।

কিন্তু ভুল হিসাবের ভিত্তিতে ব্যাংককে জরিমানা করা বা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুসরণ করেই ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ (শেয়ারবাজার এক্সপোজার) হিসাব করা হয়। জরিমানা করার আগে আইন ও বিধিবিধান
লঙ্ঘনের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়েই জরিমানা করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এস এম রবিউল হাসান বলেন, এক্সপোজার গণনা বিষয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকলে তা যথাযথভাবে জানালে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই পর্যালোচনা করবে। ভুল হলে তা সংশোধনে আপত্তি নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কখনই শেয়ারবাজারের অগ্রগতিতে বাধা হতে চায় না। কোনো কোনো মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে শেয়ারবাজারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে বলে উল্টো অভিযোগ তার।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ কঠোর অবস্থান নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তাদের দাবি, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বিষয়ে খুবই রক্ষণশীল নীতি অবলম্বন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেয়ারবাজার সূচক বাড়লেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নজরদারি জোরদার করে। এতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, প্রতি ১৫ দিন অন্তর ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা সৃষ্টির পরই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এমনকি সরাসরি ব্যাংকগুলোতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। গত রোববার সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও গত সোমবার গিয়েছিল সাউথইস্ট ব্যাংকে, যা বাজারে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শেয়ারবাজারে ধস নামার পর আমানতকারীদের সুরক্ষার স্বার্থে ২০১৩ সালে আইন সংশোধন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সীমা বহুলাংশে কমানো হয়। এ ছাড়া যেসব ব্যাংক সরাসরি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করত, তাদের পৃথক সহযোগী কোম্পানির অধীনে ওই ব্যবসা পরিচালনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর অভিযোগ, কোনো ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংকের শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে তা দুই ব্যাংকের এক্সপোজার হিসেবে গণ্য করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উদাহরণস্বরূপ, `এক্স` ব্যাংক `ওয়াই` ব্যাংকের ব্রোকারেজ হাউসকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়, তবে তা প্রথমত এক্স ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ (সলো বেসিস) হিসেবে গণ্য হয়। আবার ওয়াই ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ (কনস্যুলেটেড বেসিস) হিসেবেও গণ্য হয়। অর্থাৎ ১০০ কোটি টাকার ঝুঁকিকে ২০০ কোটি টাকার ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এতে একটি ব্যাংক অন্তত ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছে। ঋণগ্রহীতা কোনো ব্যাংকের সহযোগী না হলে তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি ১০০ কোটি টাকা হিসাব করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের যুক্তি, আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুযায়ী এ হিসাব করা হচ্ছে।

আবার সহযোগী কোম্পানিতে কোনো ব্যাংকের মূলধনী বিনিয়োগ শেয়ারবাজার এক্সপোজার থেকে বাদ দিয়ে ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সার্কুলার জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সহযোগী কোম্পানি ওই মূলধন থেকে অবকাঠামোসহ প্রশাসনিক কাজের বাইরে যে অংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে, তাও সংশ্নিষ্ট ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সার্কুলারেরই ব্যত্যয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের যুক্তি, এ ক্ষেত্রেও হিসাব মান অনুসরণ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া সহযোগী কোম্পানি মূল কোম্পানি (ব্যাংক) থেকে ঋণ নিয়ে একটি অংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা রাখলেও, অর্থাৎ পুরো অর্থ বিনিয়োগ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গৃহীত ঋণের পুরোটাই শেয়ারবাজার এক্সপোজার হিসেবে গণ্য করে। উপরন্তু সহযোগী কোম্পানিকে দেওয়া ঋণ বা ঋণসীমার মধ্যে যেটি বেশি, তা ওই ব্যাংকের শেয়ারবাজার এক্সপোজার হিসেবে গণ্য করে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা হলো, ঋণের সীমা কম করে দেখালে এ সমস্যা থাকে না। কোন ব্যাংকগুলো বাড়তি সীমা দিয়ে রাখছে, তাও খতিয়ে দেখতে হবে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রেও হিসাব মান অনুসরণ করা হচ্ছে।

তা ছাড়া বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য বিবেচনায় না নিয়ে সর্বশেষ বাজারমূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যাংক ১০০ টাকার শেয়ার ক্রয়ের পর তা বাজারমূল্য ২০০ টাকা হলেও এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি মাত্র ১০০ টাকা। প্রতিবেশী ভারতসহ অন্য দেশে ক্রয়মূল্যকে (১০০ টাকা) এক্সপোজার হিসাব গণ্য করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জবাব হলো, শেয়ারবাজারের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে অনেক দেশে বাজারমূল্যভিত্তিক এক্সপোজারও গণনা করে। দেশজ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ নীতি অনুসরণ করে। ভারতে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ খুবই কম। এমনকি বাংলাদেশের মতো সহযোগী কোম্পানি গঠন করে শেয়ারবাজার কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায় না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আরও অভিযোগ হলো, ব্যাংকের সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস থেকে মার্জিন ঋণ গ্রাহকদের শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে শুধু ক্রয়ের হিসাব নেওয়া হচ্ছে, বিক্রির হিসাব নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো দিনের কেনাবেচা নিট হিসাব দিতে চাইলেও তা নিতে নারাজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর বিশেষায়িত ব্যাংক বিডিবিএল শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ আইনি সীমায় নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে নিজস্ব ৮০০ কোটি টাকার পোর্টফোলিও থেকে মূলধন জোগান হিসেবে ৫৭০ কোটি টাকার শেয়ার সহযোগী দুই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অনুমোদন রয়েছে। তারপরও বিশেষায়িত এ ব্যাংককে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর আহমেদ সমকালকে বলেন, তারা আইন পরিপালন করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান। বিনিয়োগ আইনি সীমা অতিক্রম করায় আইনের মধ্যে থেকেই তা সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পর পরবর্তী ধাপে আছে। এ অবস্থায় জরিমানা করায় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর এমন অভিযোগের বিষয়ে সহমত পোষণ করে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয় সভায় বহুবার বিষয়টি তোলা হয়েছে। গুটিকয় ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনলেও প্রকৃত সমস্যা সমাধানে কখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

সাইফুর রহমান বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২০১১ সালে জারি করা একটি সার্কুলারে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে এমন যে কোনো উদ্যোগ, পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণের আগে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বিএসইসির সঙ্গে পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করতে হবে বা অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কখনই বিএসইসিকে কিছু জানায় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেকে এমন অভিযোগ করলেও কখনই লিখিতভাবে তাদের সমস্যার কথা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায় না। জানালে তা বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টি ভাবা যেত। তা ছাড়া ত্রৈমাসিক সমন্বয় সভায় বিএসইসির প্রস্তাব আলোচনা হয়। আইনে তিন বছরের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা তা ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালে সহযোগী কোম্পানিকে মূলধন জোগানের অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিনিয়োগকৃত শেয়ার দিয়ে এক্সপোজার কমানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়ই শেয়ারবাজার বিষয়ে নমনীয় ও আন্তরিক।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: