০৩ জুলাই ২০১৯ বুধবার, ০৫:৫৩ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
পুঁজিবাজার নিয়ে হতাশা বেড়েই চলেছে। বাজেট প্রণোদনা ও নীতি-সহায়তা দেওয়ার পরও স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশিরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। টানা চার মাস শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন তারা। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসই পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়েছেন তারা। ভালো শেয়ারের অভাব ও টাকার অবমূল্যায়ন না হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানির বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরু থেকেই বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা দেখা যায়। নির্বাচনের পরবর্তী দুই মাস নিট বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা থাকলেও পরবর্তী চার মাস টানা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে দেখা গেছে। পুরো অর্থবছরের ৯ মাসই বিদেশিরা শেয়ার ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি বেশি করেছেন। এর ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশিরা ১৮৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল ৭১ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্র্যাক ইপিএল ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শরীফ এম এ রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আচরণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদেশিরা কখনোই বোনাস শেয়ার চান না, কারণ একটা সময় পর শেয়ার দরে সমন্বয় হয়ে যায়। অথচ স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বোনাস লভ্যাংশে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। এসইসি ও সরকারের পক্ষ থেকে বোনাস লভ্যাংশ নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের তেমন উৎসাহিত হতে দেখা যায়নি। বাজারে এর প্রভাবও পড়েনি।
শরীফ এম এ রহমান বলেন, আমরা দেখলাম একটি কোম্পানি হঠাৎ করেই বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করল। আর এ কারণেই স্থানীয়রা বিপুল আগ্রহ নিয়ে শেয়ারটি কিনলেন। ফলে দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিদেশিরা তা বিক্রি করে দিলেন। এই সময়ে তাদের শেয়ার বিক্রি বেড়ে যাওয়ার এটিই বড় কারণ।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ হিসাব বছরের জন্য বিএটি বাংলাদেশ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৭০০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ২০০ শতাংশ বোনাস। কোম্পানিটির ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ বোনাস ঘোষণা। আর এই বোনাস ঘোষণায় স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ কোম্পানির শেয়ারদর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর এ সুযোগে বিদেশিরা এ কোম্পানির উল্লেখযোগ্য পরিমাণের শেয়ার বিক্রি করে দেন। বোনাস সমন্বয়ের পর শেয়ারদর আর না বাড়ায় স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ এ শেয়ারে আটকা পড়েন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। সদ্য শেষ হওয়া হিসাব বছরে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বিপরীতে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ২০১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ হিসাবে ১৮৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা শেয়ার বিক্রি করেন বিদেশিরা। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত টানা চার মাস বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে দেখা গেছে। এর ফলে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সঙ্গে নির্বাচনের সংযোগ ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় মুদ্রার মান কমিয়েছে বা অবমূল্যায়ন করেছে। তবে বাংলাদেশ এখনো বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। গত সাত বছরে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নিজস্ব মুদ্রার ৫০ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন করেছে। এ হিসেবে টাকার অবমূল্যায়ন তেমন হয়নি। বিদেশিদের ধারণা, বাংলাদেশও তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হবে। এটি হয়ে গেলেই তারা আরও বেশি বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
বর্তমানে ডিএসইর মোট লেনদেনের মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ আসে বিদেশিদের শেয়ার কেনাবেচা থেকে। যেটা ভারতে ৩৫ শতাংশের বেশি। দেশের পুঁজিবাজারে ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিট বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা ছিল। এ সময় টানা সাত বছরে বিদেশিরা ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেছেন। এরপর থেকেই বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিবিএ সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, আস্থার সংকট ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন না হওয়া বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির বড় কারণ। প্রতিবেশী সব দেশ তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। বাংলাদেশকেও টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে, এমনটি মনে করছেন তারা। এটি হয়ে গেলেই বিদেশিদের বিনিয়োগ আসবে। এছাড়া ভালো শেয়ারের প্রচ- অভাব রয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত ১০ বছরে বাজারে প্রভাব রাখতে পারে এমন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি।
যেসব বিদেশি কোম্পানি দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে তাদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ কোম্পানি। এছাড়া সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক কিছু বিনিয়োগ কোম্পানিরও বিনিয়োগ রয়েছে। নর্ডিক দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত বিনিয়োগ কোম্পানি ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্স দেশের শেয়ারবাজারে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।