facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪

Walton

বাস্তবে রূপ পাচ্ছে ‘অর্ধেক মানুষ অর্ধেক পশু’


০৯ জানুয়ারি ২০১৭ সোমবার, ০৩:১৩  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


বাস্তবে রূপ পাচ্ছে ‘অর্ধেক মানুষ অর্ধেক পশু’

ব্রিটিশ লেখক এইচ জি ওয়েলসের সায়েন্স ফিকশন ‘দ্য আইল্যান্ড অব ডক্টর মরিও’ যারা পড়েছেন, তাদের অদ্ভূত এক ধরনের প্রাণির সঙ্গে পরিচয় থাকার কথা। দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজের নাবিক এডওয়ার্ড পেনড্রিক এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে গিয়ে দেখতে পান দানবীয়, চিবুকহীন মুখমণ্ডল বিশিষ্ট উলঙ্গ কিছু অদ্ভূত প্রাণি। এ নিয়ে লেখা সায়েন্স ফিকশনটির ওপর ভিত্তি করে হয়েছে চলচ্চিত্রও। এ ধরনের প্রাণিদের বলা হয় ‘শিমেরা’।

সায়েন্স ফিকশনটির ওই নায়ক একদিন আবিষ্কার করে ফেলেন, এই দানবীয় প্রাণিগুলো আসলে ডাক্তার মরিওর তৈরি। নিজের গবেষণাগারে বসে পশুকে মানুষে রূপান্তরের কাজ করেন তিনি। ইচ্ছেমতো দেহ এবং মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটান। তবে শত চেষ্টা করেও পশুগুলোর সহজাত প্রবৃত্তি মুছে দিতে ব্যর্থ হন। দ্বীপে সৃষ্টি হয় বিপজ্জনক নৈরাজ্য, শেষ পর্যন্ত তাদেরই শিকারে পরিণত হন ডাক্তার মরিও।
সায়েন্স ফিকশন তো সায়েন্স ফিকশনই। কিন্তু যদি বলা হয় এই ফিকশনই এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে!
দ্য আইল্যান্ড অব ডক্টর মরিও লেখার ১২০ বছর পর এবার সেই অদ্ভূত আর ভয়ঙ্কর প্রাণিগুলোই আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে! বিজ্ঞান কিন্তু এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বলতে পারেন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব এবার মূর্তমান হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এটা কি আশঙ্কার, নাকি সম্ভাবনার?

২০১৬ সালের মে মাসে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মিরর বড় করে শিরোনাম করেছিল- ‘মানুষ এবং পশুর পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলতে চান বিজ্ঞানীরা’। এর ঠিক দুই মাস পরে আশঙ্কা প্রকাশ করে ওয়াশিংটন টাইমস লিখেছিল- বুদ্ধিমান প্রাণিরা নাকি শিগগিরই দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
আসলে প্রাণিদের ভ্রুণে মানুষের স্টেম সেল ঢুকিয়ে দেওয়া যাতে সেখানে নির্দিষ্ট প্রত্যঙ্গ তৈরি হতে পারে- এ সম্ভাবনা নিয়েই এত আলোচনা। এতে করে নাকি মানবদেহের কিছু বিশেষ প্রত্যঙ্গ প্রাণি দেহেই উৎপাদন সম্ভব হবে। উদ্যোগটা খারাপ না। হৃৎপিণ্ড বা যকৃতের মতো প্রত্যঙ্গও পাবে যাবে ‘রেডিমেড’! প্রায় তিন দশকের গবেষণার পর এ ‘বিতর্কিত’ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

বিতর্কিত কেন? শুধু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উৎপাদনের জন্য একটি নতুন ধরনের প্রাণ সৃষ্টি করা হবে, এরপর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে আবার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে- ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে নৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করে।

যাই হোক, দীর্ঘ তিন দশকের গবেষণা কিন্তু জীববিজ্ঞানের জন্য বেশ কাজে লেগেছে। জীবন সম্পর্কিত বেশকিছু বড় রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। প্রাণিদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্যগুলো ধরতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা- একটি জীবন্ত সত্তার মধ্যে কী করে অন্য প্রাণির একরাশ কোষ একইসঙ্গে বেড়ে ওঠে।

এ নিয়ে কানাডার হসপিটাল ফর সিক চিলড্রেনের শিমেরা বিষয়ক গবেষক জেনেট রোসান্ট জানান, এখনকার সময়ে সবকিছুই খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ গবেষণাও জীববিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। তার মতে, জটিল কিছু নৈতিক সমস্যার সমাধান করা গেলে হয়তো মানুষের সংজ্ঞাটাও স্থায়ীভাবে পাল্টে যাবে।

‘শিমেরা’ শব্দটা আসলে গ্রিক উপকথার একটি চরিত্র। গত কয়েক হাজার বছর ধরে এটি ছিল শুধুই সাহিত্যের একটি পরিভাষা। প্রাচীন গ্রিসের এক ধরনের অমর প্রাণিকে বোঝাতে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রাণিগুলোর সামনের দিকটা সিংহের মতো, পেছনের দিকটা সাপের মতো আর মধ্যখানটা ছাগলের মতো। অবশ্য বাস্তবে এই শিমেরা একেবারেই অসম্ভব। গ্রিক উপকথার শিমেরাগ্রিক উপকথার শিমেরা জিনগতভাবে আলাদা ধরনের টিস্যুর সংমিশ্রণের ফলে তৈরি হয় বিশেষ শিমেরা। এটা হয় আবার প্রাকৃতিকভাবেই, যখন গর্ভধারণের পরপরই দুটি ভ্রুণ একীভূত হয়। এখানে একটি দ্বৈত ধরনের প্রাণির কথা ভাবা যেতে পারে, যার একপাশ দেখতে পুরুষ প্রজাতির মতো আর অপরপাশ নারীর মতো। অবশ্য এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই কোষগুলোর একীভবনের ফলে পুরো দেহে এক ধরনের সূক্ষ্ম বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। শিমেরা ঠিক এ রকমই একটি প্রাণি। ব্যাপারটা এমন যে, তোমরা দু’জন মিলে একজন। গবেষণা অনুসারে, অন্তত ৮ শতাংশ ভিন্ন ধরনের জমজ তাদের ভাই বা বোনের কোষের সঙ্গে একীভূত হয়।

গ্রিক উপকথার ওইসব প্রাণি নিঃসন্দেহে বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে বিজ্ঞানীরা তো আর থেমে থাকবেন না। তারা ঠিকই এই হাইব্রিড প্রজাতিটি উৎপাদনের জন্য গবেষণাগারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৮০ সালে কানাডার ব্রোক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় এ নিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন জানেট রোসান্ট। পূর্ব-এশিয়ার রিওকিও প্রজাতির ইঁদুর আর গবেষণাগারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে তৈরি সাদা অ্যালবিনো ইঁদুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি ‘শিমেরা’ উৎপাদন করেছেন বলে সেখানে ঘোষণা দেন তিনি।

এর আগেও এ ধরনের প্রচেষ্টা হয়েছে। তবে তার প্রায় সবগুলোই বলা যায় বিজ্ঞানীদের হতাশ করেছিল। কোনো ভ্রুণই জরায়ুতে খাপ খাওয়ানো যায়নি। সবগুলোই বিকৃত হয়ে গেছে। রোসান্ট এখানে একটি কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। সঙ্গমের চারদিন পর নিষিক্ত ডিম্ব ছোট ছোট কোষগুচ্ছে বিভক্ত হয়ে যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘ব্লাস্টোসাইস্ট’। এর ভেতর থাকা কোষগুলোকে (সেল মাস) সুরক্ষা দেয় ‘ট্রফোব্লাস্ট’ নামের বাহ্যিক এক ধরনের আবরণ। সেখান থেকেই তৈরি হয় অমরা।

উইলিয়াম ফ্রেলসের সঙ্গে মিলে কাজ করার সময় রোসান্ট অ্যালবিনো ইঁদুরের জাইগোটের মধ্যে রিওকিও প্রজাতির ইঁদুরের সেল মাস ইনজেকশনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেন। পরে সেটি অ্যালবিনো মা ইঁদুরের গর্ভাশয়ে স্থাপন করা হয়। এরপর গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৮ দিন।

এরপর যে ফলাফল পাওয়া গেল তাকে বলা যায় এক বিস্ময়কর সফলতা। ৪৮টির মধ্যে ৩৮টি ইঁদুরের বাচ্চা উৎপাদনেই কাঙ্ক্ষিত ফল আসে। রোসান্ট বলেন, ‘আমরা দেখাতে পেরেছি যে সত্যিকার অর্থেই প্রজাতিগত সীমানা ভেঙে ফেলা সম্ভব।’ এমনকি নতুন উৎপাদিত প্রজাতিগুলো তাদের মা-বাবাদের থেকেও প্রকৃতিগতভাবে আলাদা। এটাকে ‘অদ্ভূত মিশ্রণ’ আখ্যা দেন রোসান্ট।
সুতরাং দুই ভিন্ন প্রজাতির ইঁদুর মিলে যা তৈরি হলো তাকে আমরা শিমেরা-ই বলতে পারি।

আজকের স্নায়ুবিজ্ঞান যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, রোসান্ট মনে করেন, তার এ গবেষণা এতে আলাদা প্রজাতিগুলো কেন ভিন্ন ধরনের আচরণ করে, তা বুঝতে সহায়তা করবে। তবে তার প্রথম দিকের এ কাজগুলো ছিল বলা যায় একেবারেই মৌলিক জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজ। কারণ জিনগত গবেষণার বিষয়টি তখন ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। তার ওই গবেষণা দুটি ভিন্ন প্রজাতির পার্থক্য দেহের ভেতর কীভাবে কোষগুলো ছড়িয়ে থাকে তা বুঝতে সাহায্য করবে। ফলে প্রাথমিক অবস্থায় ভ্রুণ থেকে কী করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি হয় তাও বুঝতে পারবে জীববিজ্ঞানীরা।

রোসান্টের পদ্ধতি ব্যবহার করে আরো অনেকেই বর্তমানে শিমেরা উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ছাগল এবং ভেড়ার প্রজাতির মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন প্রজাতির প্রাণি উদ্ভানের জন্য কাজ করছেন। এখন নতুন লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মিশ্র প্রজাতি তৈরি করা। গত দুই দশক ধরে মানব দেহের স্টেম সেল অন্য প্রাণির দেহে তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের টিস্যু তৈরি সম্ভব হবে এবং নতুন প্রত্যঙ্গের পুনরুৎপাদনও সম্ভব হবে। এতে মানবদেহের রোগাক্রান্ত প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

সমস্যা হচ্ছে কোষগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির অনেকটা মিল থাকলেও এগুলো অভিন্ন নয়। এ পর্যন্ত এ ধরনের প্রতিস্থাপন নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালানো হয়নি। এখন পর্যন্ত এটা তাত্ত্বিকভাবেই শুধু সম্ভব। বর্তমানে মানুষের জন্য প্রত্যঙ্গ তৈরিতে শূকরের শিমেরা তৈরিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কারণ শারীরিকভাবে মানুষের সঙ্গে সবচে বেশি মিল রয়েছে এই প্রাণিটির। এটা সফল হলে মানুষের প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের অনেক সমস্যাই সমাধান করা যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

এছাড়া মানুষ এবং প্রাণির সংমিশ্রণে তৈরি শিমেরাও এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে অনেক প্রাণির ক্ষেত্রেই শিমেরার প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন সাফল্যের মুখ দেখেছে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু জটিল।

এসব বিষয় এখনো পরীক্ষণের মধ্যেই আছে। তবে এই চেষ্টা সফল হওয়ার একটি বড় সম্ভাবনা দেখছেন রোসান্ট। বিশেষ করে শূকরের দেহে মানুষের জন্য প্রত্যঙ্গ উৎপাদনের বিষয়টি খুবই সম্ভাব্য। কারণ, এই দুই প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনমূলক দূরত্ব খুবই কম। বেশিরভাগ সমস্যাই এখন পর্যন্ত প্রযুক্তিগত।শূকরের সাথে মানুষের কোষের মিল সবচে বেশিশূকরের সাথে মানুষের কোষের মিল সবচে বেশিএর বাইরে নৈতিক বিষয়টি তো থাকছেই। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ মানুষ এবং প্রাণির মিশ্রণে তৈরি শিমেরা প্রকল্পে অর্থায়নে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে। বিষয়টি আরো পর্যালোচনার পর ওই স্থগিতাদেশ তোলা হবে বলেও জানানো হয়েছে।

এ নিয়ে ন্যাচার জার্নালের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘আমাদের প্রতিক্রিয়া নৈতিক আলোচনায় যাওয়া উচিত নয়। শিমেরার ধারণা কারো কারো কাছে বিদঘুটে মনে হতে পারে, কিন্তু অনিমরাময়যোগ্য রোগীদের যন্ত্রণা আরো বেশি ভয়ঙ্কর। আমাদের আলোচনা এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত।’

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

বিশেষ প্রতিবেদন -এর সর্বশেষ