facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪

Walton

বাংলার অগ্নিযুগের বীর সেনানী ক্ষুদিরামের জন্মদিন


০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ শনিবার, ০৫:২৮  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


বাংলার অগ্নিযুগের বীর সেনানী ক্ষুদিরামের জন্মদিন

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি- এ গানের কথা ও সুরে আবেদন আজো মানুষের অনুভূতিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। যার স্বদেশপ্রেম ও আত্মত্যাগকে কেন্দ্রে করে এ মর্মবিদারক গানটি একদা রচিত হয়েছিল, সেই শহিদ দেশপ্রেমিকের নাম ক্ষুদিরাম বসু।

ক্ষুদিরাম বসু শুধু আজ আর একটি নাম নয়। এদেশের ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। অনেকে বলেন, বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম বসু। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন তৃতীয় শহিদ। তবে ফাঁসির মঞ্চে যারা আত্মা উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের মধ্যে ক্ষুদিরামই প্রথম। প্রথম শহিদ প্রফুল্ল চক্রবর্তী। দ্বিতীয় শহিদ প্রফুল্ল চাকী এবং তৃতীয় শহিদ ক্ষুদিরাম বসু।

এ বীর বিপ্লবীর জন্ম মেদিনীপুর শহরের অদূরবর্তী হাবিবপুর গ্রামে, মতান্তরে কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী গ্রামে ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। তার পিতার নাম ত্রৈলোক্যনাথ বসু।
ছয় সাত বছর বয়সে, অল্পকালের ব্যবধানে তিনি বাবা ও মা দুজনকেই হারান। সেই থেকে তিনি বড়বোন অপরূপা দেবীর কাছে দাশপুর থানার বাটগাছিয়া গ্রামে মানুষ হতে থাকেন।
এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তার বোন অপরূপা দেবী বলেছেন :

“এর আগে পরপর দুটো ভাই মারা গেছে। আর আমরা বাঙালি ঘরের অভিসম্পাত নিতে নিতে তিনটি বোন অক্ষয় অমর হয়ে বেচে রইলাম। এ লজ্জা রাখবার যেন ঠাই পাচ্ছিলাম না। তাই ছোট ভাইটি যখন হল কি আনন্দ আমাদের। নবজাত ভাইটিকে পাখি কিনে দিয়েছিলাম তিনমুষ্ঠ ক্ষুদ দিয়ে।”

“আমাদের এদিকে একটি সংস্কার আছে, পরপর কয়েকটি পুত্রসন্তান মারা গেলে মা তার কোলের ছেলের সমস্ত লৌকিক অধিকার ত্যাগ করে বিক্রি করার ভান করেন। যে কেউ কিনে নেয় কড়ি দিয়ে, নয়তো ক্ষুদ দিয়ে। তিন কড়ি দিয়ে কিনলে নাম হয় তিনকড়ি। পাঁচ কড়ি দিয়ে কিনলে নাম হয় পাঁচকড়ি। তিন মুঠো ক্ষুদ দিয়ে কিনেছিলেন বলে ভাইটির নাম হল ক্ষুদিরাম।”

ক্ষুদিরাম প্রথমে তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলে, পর মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষালাভ করেন।

সেবা ও দুঃসাহসিকতার কাজে বাল্যকাল থেকেই তিনি প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন। এ সময়ে তার এক সহপাঠি তাকে বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা দেয়ার আগে তার শিষ্যদের জিজ্ঞেস করতেন, দেশের জন্য মরতে পারবি তো। ক্ষুদিরামকেও একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। ক্ষুদিরাম দ্বিধাশূন্য কন্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, পারব বৈকি।

এ ছোট কথাটির মধ্যেই ক্ষুদিরামের দেশের জন্য মমতা ও তেজস্বিতার প্রমাণ মেলে। এরপর থেকেই তিনি সাধারণ বাঙালির নিরীহ জীবন যাপন ত্যাগ করে বিপ্লবীদের দুঃসাহসিক ও ত্যাগের জীবন বরণ করে নেন।

নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত দেখে সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাকে যুগান্তর দলে টেনে নন। এই দল গঠনের উদ্দেশ্যই সত্যেন্দ্রনাথ এক তাঁতশালা খুলেছিলেন। কাজের নাম করে বিপ্লবীরা তাঁতশালায় এসে মিলিত হতেন। এখানে কেউ কাপড় বুনতেন, ব্যায়াম করতেন, গীতা পাঠ করতেন এবং সেই সঙ্গে মাতসিনি ও গ্যারিবল্ডি প্রমুখ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর জীবনকাহিনী পড়তেন। নিজের হাতে রান্না করে খেতেন।

অচিরেই এই তাঁতশালার সদস্য হয়ে পড়লেন ক্ষুদিরাম নিজেও। আর তখন দিদির বাড়ির সঙ্গেও ক্ষুদিরামের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায়।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর তাঁতশালার সদস্যরা যেমন লাঠিখেলা, অসি চালনা, বোমা ফাটানো ও পিস্তল বন্দুক ছোড়া শিখতেন, পাশাপাশি তেমনি তখনকার ছেলেরা স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে বিলেতি জিনিস পোড়াতেন, বিলেতি লবণের নৌকো ডুবিয়ে দিতেন।

১৯০৬-৭ সালে কাসাই নদীর বন্যার সময় ক্ষুদিরাম সেখানে উপস্থিত হন ত্রাণকাজের জন্য। কখনো গ্রামে আগুন লাগা, ওলাওঠা ও বসন্ত হলে ক্ষুদিরাম তার দলকে নিয়ে ছুটে যেতেন সেখানে।

১৯০৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে মেদিনীপুরের মারাঠা কেল্লায় এক শিল্পী প্রদর্শনী হয়। সেখানে সে যুগের বিখ্যাত রাজদ্রোহমূলক পত্রিকা সোনার বাংলা বিলি করার দায়ে পুলিশ ক্ষুদিরামকে ধরতে গেলে তিনি পুলিশকে প্রহার করে পালিয়ে যান। কিন্তু পরে ধরা পড়েন। তার বয়স অল্প হওয়ায় পুুলিশ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯০৭ সালে কালীপুজার সময় বিপ্লবী দলের অর্থের প্রয়োজনে তিনি এক ডাক-হরকরার কাছ থেকে মেলব্যাগ ছিনিয়ে নেন। সে সময় রাজদ্রোহের মামলায় কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য কোলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেব বিপ্লবী দলের বিরাগভাজন হন। বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাবধানতার জন্য কিংসফোর্ডকে মজফফরপুরে বদলি করা হয়।

দলের আদেশে সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীপুরের ক্ষুদিরাম বসু এবং রংপুরের প্রফুল্ল চাকী রওনা হয়ে যান মজফফরপুরে। দুজনের কেউ কাউকে চিনতে না। রেলষ্টেশনেই দুই বিপ্লবীর প্রথম সাক্ষাত হয়। আলাপ পরিচয়ের পর দুজনে প্রথমে আশ্রয় নেন একটি হোটেলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজন কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকেন।
কিংসফোর্ডের বাসভবনের কাছেই ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব। অফিস আর ক্লাব ছাড়া কিংসফোর্ড তখন আর কোথাও যেতেন না।

১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। সেদিন কিংসফোর্ডের খেলার সাথী ছিলেন একজন বড় উকিল মি. কেনেডির পত্নী ও তার কন্যা। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খেলা শেষ হলো। মিস ও মিসেস কেনেডি কিংসফোর্ডের গাড়ির মতোই দেখতে অবিকল আরেকটি গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বাইরে দুই বিপ্লবী প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। গাড়িটি গেট পার হয়ে আসতে না আসতেই প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত শহর কাপিয়ে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। কেনেডি পত্নী ও তার কন্যা সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। বিধ্বস্ত গাড়ি একপাশে উল্টে পড়ে। যাকে হত্যা করার জন্য ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্লর এ বোমা নিক্ষেপ, সেই কিংসফোর্ডের অক্ষত গাড়িটি তখন মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে।

বোমা নিক্ষেপ করেই দুই বিপ্লবী ছুটলেন দুদিকে। ততক্ষণে বোমা বিস্ফোরণের খরব চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে না যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছিল না।
দুই বিপ্লবীর কেউ কেউকে আগে থেকে চেনে না। পরস্পরের পরিচয় জানে না। ইচ্ছে করই পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল পরস্পরের কাছ থেকে। বিপ্লবী দলের এটাই ছিল নিয়ম।
ক্ষুদিরামকে বলা হয়েছিল, তোমার সঙ্গীর নাম দীনেশ রায়। আর প্রফুল্ল চাকী জানতেন তার সঙ্গীর নাম হবেন সরকার।

পুলিশের চোখ এড়ানোর জন্য সারারাত রেললাইন ধরে হেটে পরের দিন ভোরে ২৪ মাইল দুরবর্তী ওয়াইসি রেলষ্টেশনে পৌছান ক্ষুদিরাম। ক্ষুধায় প্রচণ্ড কাতর হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই এক দোকানে ঢুকলেন কিছু কিনে খাবার জন্য। অদুরেই দাড়িয়ে ছিল দুজন পুলিশ। তারা হাতে খৈনি তৈরি করছিল। তাদের একজেনর নাম ফতে সিং, অন্যজনের নাম শিব প্রসাদ মিশ্র। ক্ষুদিরামকে দেখেই কেমন সন্দেহ হলো তাদের। ফলে তারা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ক্ষুদিরামের দিকে।

পুলিশ দেখেই ক্ষুদিরাম ভয়ে দৌড়াতে শুরু করে। পুলিশের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। এসে জাপটে ধরে ক্ষুদিরামকে। ওয়াইসি ষ্টেশনে ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন ১ মে তারিখে। আর অমনি খবর রটে গেল মিসেস ও মিস কেনেডির ওপর বোমা নিক্ষেপকারী আসামী রিভলবারসহ ধরা পড়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে মজফফপুরের পুলিশ সুপার মি. আর্মষ্ট্রং ছুটে এলেন ওয়াইসিতে।

ক্ষুদিরামের সারামুখে তখন শিশুসুলভ হাসির খেলা। মি. আর্মস্ট্রং দেখে অবাক হলেন এই কিনা খুনের আসামী। গোটা শহর যেন ভেঙে পড়ল স্টেশনে।
পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় ক্ষুদিরাম একবার ঘুরে তাকালেন উপস্থিত জনতার দিকে। সেখান থেকে ধ্বনি উঠল, বন্দে মাতরম, বন্দে মাতরম।

ষ্টেশন থকে সোজা ইউরোপিয়ান ক্লাব। তারপর জেলা ম্যাজিষ্ট্রে মি. এইচ সি. উডম্যানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। ক্ষুদিরাম তার জবানবন্দিতে বললেন :

“আমার নাম ক্ষুদিরাম বসু, বাড়ি মেদিনীপুর। এন্ট্রান্স ক্লাব পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। আমি এখানে এসেছিলাম কিংসফোর্ডকে হত্যার করার জন্য। তর মতো উৎপীড়ক ম্যাজিষ্ট্রেট ভারতে দ্বিতীয়টি নেই। তাকে বধ না করে দুইজন নিরপরাধিনী স্ত্রীলোককে আমি হত্যা করেছি এ জন্য আমার মর্মান্তিক যাতনা হচ্ছে। মেদিনীপুর থেকে আমি এখানে এসেছি। হাওড়ায় আসার পর দীনেশের সঙ্গে দেখা হয়। দীনেশের সঙ্গে একটি বোমা ছিল। দীনেশ বোমা তৈরি করতে পারত। আমার সঙ্গে দুটি রিভলবার ও কতকগুলো গুলি ছিল। ওটা আমি কোলকাতা থেকে কিনেছিলাম।

আমরা ৭/৮ দিন আগেই মজফফরপুরে পৌছে ধর্মশালায় থেকেছি। আমরা সর্বদা কিংসফোর্ডের খবর নিতাম। আমরা দেখলাম কিংসফোর্ড কুঠি থেকে কয়েক গজ দুরের ক্লাব ছাড়া আর কোথাও যান না। একদিন কাচারিতে গিয়ে দেখলাম তিনি সেখানে বিচার করছেন, সেখানে বোমা ছুড়লে অনেক নিদোর্ষ মানুষের মৃত্যু হবে বিবেচনা করে বিরত হই।
৩০ এপ্রিল কিংসফোর্ডের গাড়ি কখন ক্লাব থেকে বের হয়ে আসবে সেই প্রতীক্ষায় ছিলাম। একখানা গাড়ি আসছে দেখেই আমি বোমা নিক্ষেপ করেছিলাম। আমাদের উভয়ের পা-ই খালি ছিল। বোমা নিক্ষেপের পর দীনে বাকিপুরের দিকে পালিয়ে যায়। আমি সমস্তিপুরের দিকে।

ওয়াইসি ষ্টেশনে একটি মুুদির দোকানে যখন জল খাচ্ছিলাম তখন দুজন কনস্টেবল আমাকে গ্রেফতার করে। কলকাতায় এক গুপ্ত সমিতি আছে। সেই সমিতি কর্তৃক নিযুক্ত হয়েই আমি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে এসেছিলাম। যদি ধরা পড়ি, তা হলে তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যা করার জন্য পিস্তল সঙ্গে রেখেছিলাম।”

প্রফুল্ল যে আত্মহত্যা করে, সে কথা ক্ষুদিরাম জানতে পারেন ৩ মে। মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় শনাক্ত করার জন্য। ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে ডাক পড়ে ক্ষুদিরামের। মৃত ব্যক্তি তার সঙ্গী এবং তার নাম দীনেশ রায়, সে কথা তিনি স্বীকার করেন। এরপর শুরু হলো মামলা।

২১ মে প্রাথমিক বিচারের জন্য ক্ষুদিরামকে হাজির করা হয প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট মি. ই. বি. বার্নার্ডের আদালতে। ২৩ মে আবার বিবৃতি দিলেন ক্ষুদিরাম। তবে আগের বিবৃতির সঙ্গে দ্বিতীয়বারের বিবৃতির কিছু গরমিল ছিল। তার প্রথম বিবৃতির লক্ষ্য ছিল সব দায়িত্ব নিজের ঘারে নিয়ে প্রফুল্ল চাকিকে বাচানো। কিন্তু তারপর যখন দেখলেন যে প্রফুল্ল চাকী মারা গেছেন, তখন তিনিও বিবৃতি কিছুটা পরিবর্তন করেন। এদিকে তিনি বলেন :

“একদিন আমি যখন খেতে বসেছি, সেই সময় দীনেশ আমার কাছে আসে। দেখামাত্র পরিচয় জানতে চায়। আমার নাম শুনে সে আমাকে চিনতে পারে। কারণ আমার বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে পুলিশ একটি মামলা করেছিল। কথাবার্তার পর সে আমাকে জানায় যে, একটা কাজ কতে পারলে অনেক পুরস্কার পাওয়া যাবে। আমি রাজি হই। তখন সে আমাকে শুক্রবার তিনটের সময় হাওড়া ষ্টেশনে দেখা করতে বলে। সেখানে সে আমাকে কিংসফোর্ডকে হত্যার কথা বলেছিল। নানাভাবে বোঝাবার পরে আমিও রাজি হয়েছিলাম। দীনেশ আমাকে রিভলবার দিয়ে বলেছিলাম এগুলো কোথায় পেয়েছি সে কথা যেন কাউকে না বলি।”

মামলায় সরকারি পক্ষের উকিল ছিলেন বিখ্যাত ব্যারিষ্টার মি. মানুচ ও সরকারি উকিল বিনোদবিহারী মজুমদার। আর ক্ষুদিরামের পক্ষে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিলেন দেশপ্রেমিক আইনজীবী কালিদাস বসু, রংপুরের সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী ও নৃপেন্দ্রলাল লাহিড়ী।

মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারা মোতাবেক ক্ষুদিরামের মৃত্যুদণ্ড হয়। পরের দিন খবরের কাগজে যে বিবরণ প্রকাশিত হয়, তা ছিল এ রকমের :

“একেবারে নির্বিকারচিত্তে ক্ষুদিরাম দণ্ডাজ্ঞ শুনিলেন। নিু আদালতের কমিটির নিকট, কি উচ্চ আদালতের সেশন জজের নিকটই মামলা শুনানীকালে ক্ষুদিরাম অধিকাংশ সময়ই নির্বিষ্টভাবে কাটাইতেন। কখনো কখনো তাকে আসামীর কাঠগড়ায় নিদ্রিত অবস্থায় দেখা যাইত। আদালতে কি হইতেছে, না হইতেছে, সে সম্বন্ধে ক্ষুদিরাম প্রায়ই উদাসীন থাকিতেন। প্রাণদণ্ডযোগ্য অপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন আসামীর এই নির্লিপ্তভাব এবং ঔদাসীন্য আদালতে উপস্থিত ব্যক্তিগণের দৃস্টি আকর্ষন করিত। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার পর ক্ষুদিরামকে সম্পূর্ণ অবিচল দেখিয়া এবং তাহার নির্বিকার ভাব লক্ষ্য করিয়া বিদেশী রাজার বিজাতীয় বিচারকের মনে সম্ভবত এইরূপ ধারনা জন্মেছিলো যে, আসামির প্রতি যে চরম দণ্ড প্রদত্ত হইয়াছে, তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। এই ধারনার বশবর্তী হইয়া ফাঁসির হুকুরে পর জজ ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞাসা করিলেন- তোমার প্রতি যে দণ্ডের আদেশ হইল তাহা বুঝিতে পারিয়াছ?
ক্ষুদিরাম হাস্যমুখে মাথা নাড়িয়া জানাইল- বুঝিয়াছি।”

মামলায় ক্ষুদিরামের পক্ষের অন্যতম উকিল সতীশ চক্রবর্তী সাক্ষীদের জবানবন্দি ও দুপক্ষের উকিলের সওয়াল জবাবের পূর্বে বিচারপতির অনুমতি নিয়ে বন্দি ক্ষুদিরামের সঙ্গে একবার কথাও বলেন।

ক্ষুদিরামের ফাসির দিন ধার্য হলো ১১ আগস্ট (১৯০৮)। ততদিনে দুঃখিনী বাংলার পল্লী কবির অমর সঙ্গীত দেশের পথে প্রান্তরে, বাউল ভিখারি, ছোট বড় সকলের কন্ঠে ধ্বনিত হতে
শুরু করেছে-

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,

হাসি হাসি পরব ফাঁসি

দেখবে ভারতবাসী।

পরের ঘটনা, উপেন্দ্রনাথ সেন তার ক্ষুদিরাম গ্রন্থে বলেছেন :

“১১ই আগষ্ট ফাঁসির দিন ধার্য হইল। আমরা দরখাস্ত দিলাম যে ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিব এবং তাহার মৃতদেহ হিন্দুমতে সৎকার করিব।
… আমি তখন বেঙ্গলি কাগজের স্থানীয় সংবাদদাতা। বোমা পড়া হইতে আরম্ভ করিয়া যাবতীয় সংবাদ সে কাগজে পাঠাইতাম…।

… আমি অতি গোপনভাবে বাড়িতে বসিয়া একটি বাঁশের খাটিয়া প্রস্তুত করাইলাম। যেখানে মাথা থাকিবে সেখানে ছুরি দিয়া কাটিয়া বন্দে মাতরম লিখিয়া দিলাম।
ভোর পাঁচটায় ফাঁসি হইবে। পাঁচটার সময় আমি গাড়ির মাথায় খাটিয়াখানি ও আবশ্যকীয় সৎকারের বস্ত্রাদি লইয়া জেলের ফটকে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, নিকটবর্তী রাস্তা লোকে লোকারণ্য। ফুল লইয়া বহুলোক দাড়াইয়া আছে…।
… দ্বিতীয় লৌহদ্বার উন্মুক্ত হইলে আমরা জেলের আঙিনায় প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ডানদিকে একটু দুরে প্রায় ১৫ ফুট উচতে ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে দুইটি খুটি আর একটি মোটা লোহার রড বা আড় দ্বারা যুক্ত। তারই মাঝখানে বাধা মোটা একগাছি দড়ি ঝুলিয়া আছে, তাহার শেষপ্রান্তে একটি ফাঁস।

একটু অগ্রসর হইতে দেখিলাম ক্ষুদিরামকে লইয়া আসিতেছে চারজন পুলিশ। কথাটা ঠিক বলা হইল না। ক্ষুদিরামই আগে আগে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া যেন সিপাহীদের টানিয়া আনিতেছে।
আমাদের দেখিয়া একটু হাসিল। স্নান সমাপন করিয়া আসিয়াছিল। শেষে শুনিয়াছি, খুব প্রত্যুষে উঠিয়া স্নান করিয়া কারাবাসকালীন বর্ধিত চুলগুলো আঙুল দিয়া বিন্যস্ত করিয়া নিকটবর্তী দেবমন্দির হইতে প্রহরী কর্তৃক সংগৃহীত চরণামৃত পান করিয়া আসিয়াছি।

আমাদের দিকে আর একবার চাহিল। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল। মঞ্চে উপস্থিত হইলে তাহার হাত দুখানি পিছনে আনিয়া রজ্জুবদ্ধ করা হইল। একটি সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়া তাহার গ্রীবামুল অবধি ঢাকিয়া দিয়াগলায় ফাঁসি লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হইয়া দাড়াইয়া রহিল। এদিকে ওদিকে একটুও নড়িল না। উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখিয়া একটি রুমাল উড়াইয়া দিলেন। একটি প্রহরী মঞ্চের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি হ্যান্ডেল টানিয়া দির। ক্ষুদিরাম নিচের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরিয়া উপরের দড়িটি একটু নড়িতে লাগিল। তারপর সব স্থির।

… আমরা জেলের বাহিরে আসিলাম। আধঘন্টা পরে, জেলের দুইজন বাঙালি যুবক ডাক্তার আসিয়া খাটিয়া ও নুতন বস্ত্র লইয়া গেল।

নিয়ম অনুসারে ফাঁসির পর গ্রীবার পশ্চাৎ দিকে অস্ত্রোপচার করিয়া দেখা হয় যে, ফাঁসিতে মৃত্যু হইয়াছিল কিনা। ডাক্তার দুটি সেই অস্ত্রোপচার করা স্থান সেলাই করিয়া ঠেলিয়া বাহির হওয়া জিহ্বা ও চক্ষুদ্বয় যথাস্থানে বাসইয়া, নতুন কাপড় পরাইয়া দুইজনে খাটিয়া ধরিয়া মৃতদেহটি জেলের বাইরে আমাদের দিয়া গেলেন।

কর্তৃপক্ষের আদেশে আমরা নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে চলিতে লাগিলাম। রাস্তার দুই পাশে কিছুদুর অন্তর পুলিশ প্রহরী দাড়াইয়া আছে। তাহাদের পশ্চাতে শহরের অগণিত লোক ভিড় করিয়াছে। অনেকে শবের উপর ফুল দিয়া গেল। শ্মশানেও অনেকে ফুল দিতে আসিল। একজন সাব ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে বারোজন পুলিশ শ্মশানের এক প্রান্তে বসিয়া রহিল।
চিতারোহণের আগে স্নান করাইতে গিয়া ক্ষুদিরামের মৃতদেহ বসাইতে গেলাম। দেখিলাম মস্তকটি মেরুদণ্ডচ্যুত হইয়া বুকের ওপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে, দুঃখ বেদনা শোকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাথাটি ধরিয়া রাখিলাম। বন্ধুগণ স্নান করাইলেন। তারপর চিতায় শোয়ানো হইল, রাশিকৃত ফুল দিয়া মৃতদেহ সম্পূর্ণ ঢাকিয়া দেওয়া হইল। কেবল তাহার হাস্যেজ্জ্বল মুখখানি অনাবৃত রহিল।

দেহটি ভস্মীভূত হইতে সময় লাগিল না। চিতার আগুন নিবাইতে গিয়া প্রথম কলসী জল ঢালিতেই তপ্ত ভস্মরাশির খানিকটা আমার বক্ষে আসিয়া পড়িল। তাহার জন্য জ্বালা যন্ত্রণা বোধ করিবার মতো মনের অবস্থা তখন ছিল না।

আমরা শ্মশান বন্ধুগণ স্নান করিতে নদীতে নামিয়া গেলে পুলিশ প্রহরিগণ চলিয়া গেল। তখন আমরা সমস্বরে বন্দে মাতরম বলিয়া মনের ভার খানিকটা লাঘব করিয়া যে যাহার বাড়ি ফিরিয়ে আসিলাম। সঙ্গে লইয়া আসিলাম একটা কিছু টিনের কৌটায় চিতাভস্ম কালিদাস বাবুর জন্য।”

ক্ষুদিরামের আত্মদান বৃথা যায়নি। তার মতো হাজারো ক্ষুদিরামের মৃত্যুর পরিণতিতেই পরাধীন ভারতবর্ষ একদিন স্বাধীন হয়। মরেও তারা অমর। বাংলা কাব্যে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাদের এই আত্মবলিদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে খচিত।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

বিশেষ প্রতিবেদন -এর সর্বশেষ