facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

প্রতিযোগিতা আইন মানছে না বিকাশ


২৫ অক্টোবর ২০১৮ বৃহস্পতিবার, ১০:৫৬  এএম

নিজস্ব প্রতিবেদক


প্রতিযোগিতা আইন মানছে না বিকাশ

মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ পরিবেশকদের (ডিস্ট্রিবিউটর) সঙ্গে চুক্তি করেছে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না রাখার শর্তে। এতে সেবা পরিবেশনে বিকাশের একচেটিয়াত্ব বহাল থাকছে, যা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২-এর লঙ্ঘন।

দেশে মোবাইল ব্যাংকিং বাজারের ৮০ শতাংশের বেশি এ খাতের প্রথম প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেডের দখলে। প্রায় ২০টি মোবাইল ব্যাংকিং সেবার উপস্থিতি থাকলেও বিকাশ রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে। বিকাশের বাজার অংশ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানটির তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ।

অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না রাখার চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে সম্প্রতি পরিবেশকদের চিঠিও দিয়েছে বিকাশ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির চিফ কমার্শিয়াল অফিসার মিজানুর রশিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় অন্য যেকোনো প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যেকোনো প্রকার (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা বিকাশের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আপনার সঙ্গে সম্পাদিত ডিস্ট্রিবিউটরশিপ চুক্তির দফা ১৪-এর পরিপন্থী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর থাকা অবস্থায় অন্য কোনো প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) সম্পৃক্ত না হওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বিকাশের ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী যেকোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে) থাকার কারণে বিকাশ তার যেকোনো ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করার অধিকার সংরক্ষণ করে।’

বিকাশের এ কার্যক্রমকে প্রতিযোগিতা আইনের লঙ্ঘন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কারণ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২-এর ধারা ১৫ (১) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, গুদামজাত বা অধিগ্রহণসংক্রান্ত এমন কোনো চুক্তি কিংবা ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আবদ্ধ হতে পারবে না, যা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে অথবা বিস্তারের কারণ ঘটায় কিংবা বাজারে মনোপলি বা অলিগোপলি অবস্থা সৃষ্টি করে।

একই ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, একচ্ছত্র পরিবেশন চুক্তি অর্থাৎ কোনো পণ্য সরবরাহ বা উত্পন্ন দ্রব্যের পরিমাণকে সীমিত, সীমাবদ্ধ কিংবা স্থগিত করে বা কোনো এলাকা অথবা বাজারকে কোনো পণ্য বিক্রয় বা হস্তান্তরের জন্য নির্দিষ্ট করে এমন চুক্তি প্রতিযোগিতাবিরোধী চুক্তি হিসেবে গণ্য হবে, যদি তা প্রতিযোগিতায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে।

ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, একক বা জোটগত একচেটিয়াত্ব অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার ও প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ ও নির্মূলে ২০১২ সালে পাস হয় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইন। এর আওতায় গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।

কোনো প্রতিষ্ঠান পরিবেশকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাবিরোধী এ ধরনের চুক্তি করে থাকলে তা প্রতিযোগিতা আইনের লঙ্ঘন বলে জানান বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন ইকবাল খান চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও সক্ষমতায় কোনো খাতের বাজার দখলে নেয়া যেতে পারে। প্রতিযোগিতা আইনেও বাজার দখলের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তবে বাজারে কর্তৃত্বময় অবস্থানের সুযোগ নিয়ে অন্যদের জন্য প্রতিযোগিতাবিরোধী পরিবেশ সৃষ্টি প্রতিযোগিতা আইনের লঙ্ঘন। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে কমিশন।

২০১১ সালের জুলাইয়ে ৫০০ এজেন্টের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে বিকাশ। প্রাথমিকভাবে বিকাশ লিমিটেডে বিনিয়োগ করে ব্র্যাক ব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের মানি ইন মোশন এলএলসি। ২০১৩ সালের এপ্রিলে বিকাশের ইকুইটি পার্টনার হিসেবে যোগ দেয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। আর ২০১৪ সালে ইনভেস্টর হিসেবে বিকাশে যোগ দেয় বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিলে বিকাশের কৌশলগত অংশীদার হতে চুক্তি করেছে চীনের আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল। প্রাথমিকভাবে বিকাশের ১৬ শতাংশ শেয়ার কিনতে এ কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা ২০ শতাংশে উন্নীত হবে।

বিকাশে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশী তিন প্রতিষ্ঠানের। আলিবাবা মূলত বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ছেড়ে দেয়া শেয়ার কিনতে চুক্তি করেছে।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক রয়েছে প্রায় তিন কোটি। দিনে প্রায় ৫০ লাখ লেনদেন সম্পন্ন হয়। এর মাধ্যমে স্থানান্তরিত অর্থের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে ১৮টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালালেও বাজারের ৮১ দশমিক ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাকি ১ দশমিক ৮০ শতাংশ বাজার অন্য ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে।

বাজারে আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিস্ট্রিবিউটরদের সম্পর্ক না রাখতে বলার কথা অস্বীকার করেন বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম। তিনি বলেন, আমাদের এজেন্টরা বিকাশ ছাড়াও অন্যান্য প্রতিযোগী কোম্পানির হয়েও কাজ করছে। সেখানে কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি। আর ডিস্ট্রিবিউটরদেরও এমন কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের আগস্টে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৩। মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৪৭ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয় অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২ কোটি ৯৬ লাখ। মাসটিতে লেনদেন হয়েছে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার। দৈনিক গড় লেনদেনের সংখ্যা ৬৩ লাখ। এসব লেনদেনে মাসটিতে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০১৭ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট শেষে দেশে সেলফোনের সংযোগ সংখ্যা ১৫ কোটি ৪১ লাখ ছাড়িয়েছে। এ সময়ে ইন্টারনেট সংযোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে নয় কোটির বেশি।

আর্থিক খাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। এরই অংশ হিসেবে দেশেও চালু হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে ব্যাংকারদের ওপর পরিচালিত একটি জরিপের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, আর্থিক খাতে ডিজিটালাইজেশনের ফলে সন্ত্রাসে অর্থায়নসহ মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি বাড়ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাগুলো।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: