facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪

Walton

পুঁজিবাজারের দুঃখ অন্যত্র


১৪ জুলাই ২০১৭ শুক্রবার, ১০:৩৭  এএম

আবু আহমেদ

শেয়ার বিজনেস24.কম


পুঁজিবাজারের দুঃখ অন্যত্র

তবুও মন্দ কি— পুঁজিবাজারের বিষয়টি ঘুরেফিরে কয়েকবার সংসদের বাজেট অধিবেশনে উপস্থাপিত হয়েছে! কয়েকজন সংসদ সদস্য অর্থবাজার ও পুঁজিবাজারের ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ অন্যতম। পুঁজিবাজারের ইস্যুটি আগে সংসদে আলোচনা হতে তেমন দেখা যেত না। সংসদে বিড়ির ওপর ট্যাক্স বেশি না কম, এই নিয়ে যে আলোচনা হতো, তার চেয়েও কম আলোচনা হতো পুঁজিবাজার নিয়ে। তবে ব্যাংকিং খাত নিয়ে কিছু আলোচনা হতো। তবে সত্য হলো ব্যাংকিং এবং পুঁজিবাজারের ইস্যু দুটোই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আলোচনায় উঠে এসেছে এই দুটো খাতে লুণ্ঠন এবং কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে। ব্যাংকিং খাতে লুণ্ঠন এখনো অব্যাহত আছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকগুলো বসে গেলে অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হতে পারে, তাই নতুন করে পুঁজি জোগান দিয়ে সেগুলোকে সচল রাখতে হবে। এতে জাতির জন্য কম ব্যয় হবে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে অবিশ্বাসের কারণে ধস নামলে তা জাতির জন্য বড় বেদনার বিষয় হবে। তাই জনগণের করের টাকায় হলেও আপাতত ব্যাংকগুলোকে কিছু অর্থ জোগান দিতে হবে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যাংক ব্যবস্থার পুরোটা সংকটের মুখোমুখি নয়। চারটি-পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই কেবল বড় রকমের সংকটের মুখোমুখি। এ অবস্থার জন্য দায়ী ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তারাই অতি উত্সাহে ঋণ মঞ্জুর করে। কিন্তু আদায়ের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখায়। অসংখ্যবার বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সঙ্গে ঋণ বিতরণের সীমা আরোপ করে সমঝোতা চুক্তি সই করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সময় গেছে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য আরো খারাপ হয়েছে। জনগণের প্রতিবাদ হলো যে, আর কতবার ওইসব ব্যাংকে তাদের অর্থ জোগান দিতে হবে। তারা ঘুরেফিরে অর্থমন্ত্রীকে যে প্রশ্ন করতে চাচ্ছে, তাহলো স্পষ্ট করে বলুন, এবারের দেয়াই শেষ দেয়া আর দিতে হবে না। যদি বারবার অর্থ দিতে থাকেন, তাহলে তো বোঝা যাবে যারা ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হচ্ছে, তাদের হাতেই জনগণের করের টাকা তুলে দিচ্ছে সরকার। কয়েকজন সংসদ সদস্য বলেছেন, ওইসব ব্যাংকের ব্যাপারে বিকল্প চিন্তা করার সময় এসেছে এবং আমিও মনে করি ওই চিন্তাই হবে সঠিক চিন্তা। পুঁজিবাজারের বিষয়টি এসেছে বর্তমানের নিম্ন অবস্থান এবং ২০১০-এর কেলেঙ্কারি ও ধসের প্রেক্ষাপটে। পুঁজিবাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনেকটা পুরনো। গত বছরও তিনি প্রায় অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, ওই বক্তব্যের ইস্যুগুলো রেগুলেটর বিএসইসি-ই তাকে সরবরাহ করেছে। কিন্তু বিএসইসি তো নিজের ঢোল নিজে পেটাবেই। অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের এর মধ্যে ‘যদি’, ‘কিন্তু’ খোঁজা উচিত ছিল। অথবা বিএসইসিকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড— ইটিএফের রেগুলেশন এক বছর আগে পাস হলেও এই আর্থিক প্রডাক্ট আজো কেন চালু হয়নি।

ইটিএফ চালু করা হবে এই গল্প তো আমরা এক বছরের অধিক কাল থেকেই শুনে আসছি। আর ইটিএফ চালু হলেই বা কি! ইটিএফ দিয়ে তো আর পুঁজিবাজারকে ভালো করা যাবে না। এই যে মিউচুয়াল ফান্ডস নামের ফান্ডগুলোর ওপর বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাল, সেটা কেন ঘটল অর্থ মন্ত্রণালয় কি এ ব্যাপারে খবর রাখে? আজকে মিউচুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রি বলতে যা বোঝায়, তা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অনুপস্থিত। অথচ এক সময়ে বড় গলায় বলা হতো এই ইন্ডাস্ট্রি হলো পুঁজিবাজারের প্রাণ। যারা শেয়ার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দুর্বল, তারা মিউচুয়াল ফান্ডের দিকে যান। লোকজন গেল বটে, তবে ওখানে মার খেয়েছে বটে। তারা পুঁজি হারিয়েছে মিউচুয়াল ফান্ড  কিনে। আজকে মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রেডিং তেমন হয় না বললেই চলে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন, পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটলমেন্ট কোম্পানি গঠন করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এবং স্বল্প মূলধনের কোম্পানিগুলোর শেয়ার ট্রেডিংয়ের জন্য স্মল ক্যাপ ট্রেডিং প্লাটফর্ম চালু করার বিষয়টি চিন্তায় আছে। আমি বুঝলাম না এই দুটো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পুঁজিবাজার কীভাবে উন্নত হবে? যে বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের বড় অভাব, যে বাজারে টার্নওভার গড়ে ৬০০-৭০০ কোটি টাকা, সে বাজারে হঠাত্ করে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের জন্য আলাদা বাজার চালু করতে হবে কেন? এই ধরনের বাজার চালু হলে ক্ষতিই বেশি হবে। ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটলমেন্ট কোম্পানি গঠন কিংবা স্বল্প মূলধনি বাজারের জন্য আলাদা ট্রেডিং প্লাটফর্ম—  এগুলো বিশ্বের কোনো কোনো পুঁজিবাজারে আছে বটে, তবে সেসব বাজার অনেক বড় এবং ওইসব বাজারে ডাইভারসিফায়েড আর্থিক প্রডাক্টস আছে। আমাদের বাজারে শুধু একমুখী বা একমাত্রিক আর্থিক প্রডাক্ট রয়েছে। এই বাজারে আরেকটা ক্লিয়ারিং কোম্পানি বা আরেকটা ট্রেডিং প্লাটফর্ম স্থাপন করা আবশ্যক বা উপকারী কোনো বিষয় নয়। এটি আসছে অনুসরণের ধারণা থেকে। এবং সেগুলো অলস মস্তিষ্কের আবিষ্কারও বটে। কিছু করার খাতিরে বিএসইসি মাঝে মধ্যে এমন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলে। পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে করপোরেট গভর্ন্যান্স নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। কিছু উন্নতি এক্ষেত্রে হয়েছে। তবে অনেক কোম্পানি মূল চেতনাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। তারা শুধু তাত্ত্বিক অর্থে সুশাসনের বিষয়গুলোকে পালন করে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আইপিওগুলো আসছে। কোনো ক্ষেত্রে পার ভ্যালুতে, কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামে। কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতেই সেগুলো মূল্য হারায়। যে মূল্যে আইপিওগুলো বেচা হয়েছে, সে মূল্যের অনেক নিচে এগুলোকে ট্রেডিং হতে দেখা যায়। আইপিও বাজারেও বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছে। মিথ্যা কথা বলে আইপিওগুলো আনা হচ্ছে। পরে দেখা যায় কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। মামলায় পড়ে উৎপাদন আটকে আছে। তাহলে প্রশ্ন, ওইসব কোম্পানি বাজারে এল কীভাবে! ওসব মরিচা ধরা কোম্পানির উদ্যোক্তারা কিন্তু ঠিকই তাদের শেয়ারগুলো বেচে বের হয়ে গেছে। এখন তাদের হাতে আছে ২০-২৫ শতাংশ। অথচ বিএসইসি সেই শেয়ার বেচাও বন্ধ করতে পারেনি। এখন অতি ধনী হওয়ার আরেক পথ হলো কোম্পানি করে আইপিও বেচা। গত বছর অর্থমন্ত্রী মহোদয় বাজেট অধিবেশনে বলেছিলেন, আইপিও তথা প্রাইমারি বাজারটা ভালো আছে। সমস্যা হচ্ছে সেকেন্ডারি বাজার নিয়ে। এই বাজারটা ঝিমিয়ে আছে। কিন্তু আইপিও বাজারের ভালোটা কি শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো হচ্ছে। ওইসব কোম্পানির আইপিও কিনে বিনিয়োগকারীরা কি প্রতারিত হয়নি? ভালো আইপিও ছাড়া ভালো সেকেন্ডারি বাজার পাওয়া যাবে না। সেকেন্ডারি বাজার হলো  ট্রেডিং বাজার। মরিচায় আক্রান্ত শেয়ার বেশি হলে সেকেন্ডারি বাজারে জুয়া চলবেই। বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়েই তো জুয়াড়িরা বেশি মাতামাতি করে। তাদের উদ্দেশ্য অবশ্য ভিন্ন। আজকে যেসব ইস্যু নিয়ে বিএসইসি অথবা সরকারের উচ্চ মহল কথা বলছে, তার থেকে অনেক বেশি উপকারী হতো সরকার যদি বছরে দু-তিনটা ভালো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনতে পারত। কয়েক মাস আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এবার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আসতে হবে। তিনি বলেছেন কিনা জানি না, তবে বললে তো সংবাদে দেখতাম। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিজ ইচ্ছায় শেয়ারবাজারে আসবে না। তাদের আসতে বলতে হবে। না এলে কি করতে হবে, সেটা আশা করি অর্থ মন্ত্রণালয় জানে। অন্য দেশে ইউনিলিভার, নেসেল, মেটলাইফের মতো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত থাকলে আমাদের শেয়ারবাজারে সেগুলো কেন থাকবে না— এই প্রশ্ন কি সরকার তাদেরকে কখনো করেছে? একটা ভালো  উপায় হতে পারত তালিকাভুক্ত হলে করপোরেট আয়করকে আরো কমিয়ে দেয়া। করপোরেট ট্যাক্স কম দেয়ার জন্য কোনো কোনো বহুজাতিক এবং স্বদেশী ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসার আগ্রহ অনুভব করত। কিন্তু পাস হয়ে যাওয়া অর্থবিলে সেরকম কোনো প্রণোদনা আসেনি। অন্য বিষয় হলো, যেটি বিএসইসি কোনো দিনই মাথা ঘামায়নি— অনেক বহুজাতিক কোম্পানি লাইসেন্স ফি, রয়্যালটি, টেকনিক্যাল ফির নামে শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো, তারা যে বার্ষিক প্রতিবেদন শেয়ারহোল্ডারদের জন্য প্রকাশ করে, তাতে কেন, কোন চুক্তি বলে এবং কীসের ভিত্তিতে উপরোক্ত খাতে অর্থ বাইরে যেতে দিতে হবে, তার উল্লেখ থাকে না।

এসব ব্যাপারে অডিটর বা নিয়ন্ত্রককে জিজ্ঞেস করলে, তারা বলে বিএসইসি স্পষ্ট গাইড লাইন না দিলে লাইসেন্স ফি, রয়্যালটি, টেকনিক্যাল ফির ক্ষেত্রে আপনারা যে স্বচ্ছতা পাচ্ছেন, তা আমাদের পক্ষে বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ডেরও একটা ভূমিকা আছে। উপরোক্ত খাতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে অর্থ বাইরে স্থানান্তর করছে, তার ফলে রাজস্ব বোর্ড কম ট্যাক্স পাচ্ছে। কারণ হলো, ওইসব খাতে ব্যয়িত অর্থকে ব্যয় হিসাবে দেখানো হচ্ছে। রাজস্ব বোর্ড বলতে পারে ডিভিডেন্ড ছাড়া অন্য খাতে অর্থ ব্যয় দেখিয়ে বাইরে নিতে হলে কোন চুক্তির অধীনে, কত দিনের জন্য এবং কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে ওইসব খাতে অর্থ বাইরে নেয়া হচ্ছে, তা বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা পুকুর চুরির ক্ষেত্রে যেন ধর-মার-কাট, কিন্তু সাগর চুরিকে তারা দেখেও দেখে না। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি ওইসব খাতে তাদের ইকুইটি বা মূলধনের কয়েক গুণ অর্থ লাইসেন্স ফি, ব্যবস্থাপনা ফি, রয়্যালিটির নামে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এটি দেখার কাজ মূলত বিএসইসির, কিন্তু সত্য হলো তারা পুরনো ক্যাসেট বাজাতেই ব্যস্ত।

একটা ভালো কাজ হয়েছে যেটা সরকার বড় গলায় বলতে পারে, সেটা হলো আর্থিক রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) পাস করানো। এই অ্যাক্টের অধীনে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর মধ্যে এফআরসির চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। আশা করি, ভবিষ্যতে আর্থিক প্রতিবেদনগুলো আরো উন্নত হবে। বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক বিভিন্ন খাতে অর্থ সরানোর ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপসহ এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ব্যাপারে নবপ্রতিষ্ঠিত এফআরসি দিকনির্দেশনা দিতে পারে।


লেখক: অর্থনীতিবিদ

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: