facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪

Walton

পুঁজিবাজারে ফের মন্দার কারণ তাহলে এই


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সোমবার, ০৯:৩৯  পিএম

নিজস্ব প্রতিবেদক


পুঁজিবাজারে ফের মন্দার কারণ তাহলে এই

ব্যাংকের সুদহার, তারল্য পরিস্থিতি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, মজবুত মৌলভিত্তির ও বড় মূলধনী কোম্পানির তালিকাভুক্তিসহ যেসব নির্দেশকের সঙ্গে পুঁজিবাজারের ভাগ্য জড়িয়ে আছে, সেগুলোর কোনোটিই অনুকূলে নেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে শেয়ারবাজারে চলছে দরপতনের ধারা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনে পুঁজিবাজারে মন্দার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছে, লাগামহীন খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট ব্যাংক খাতের আর্থিক স্বাস্থ্যে অবনতি পুরো অর্থ ও পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে সুদহার বাড়ায় পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি ব্রোকারদের বিনিয়োগে অনীহা পুঁজিবাজারকে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে সূচকের কিছুটা ঊর্ধ্বগতি হলেও তাতে সবার অংশগ্রহণ ছিল না; মূলত কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস, কিছু ব্যক্তি বিনিয়োগকারী ও বিদেশি একটি গোষ্ঠীর শেয়ার কেনায় দ্রুত সূচক বাড়ে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে বিদেশিরা শেয়ার কেনা কমিয়ে দিয়েছে।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) চলতি বছর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত শেয়ারের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়ে পাঁচ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে ওঠে। কিন্তু এরপর থেকে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ছেদ পড়েছে, ডিএসইএক্স ২০০ পয়েন্ট কমে পাঁচ হাজার ৭৫০ পয়েন্টে নেমেছে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার বড় নিয়ামক। আমানতের সুদহার কম থাকলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ে; সুদহার বাড়লে উল্টো ঘটনা ঘটে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার বেড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশসহ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো থেকে বিদেশিরা বিনিয়োগ তুলে নিয়ে সেখানে বিনিয়োগ করে। ডিএসইর মূল্য সূচক কমেছিল ১৩ দশমিক ৮  শতাংশ। এছাড়া ভারতের, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার শেয়ারবাজার ৫ থেকে ৯ শতাংশের বেশি দর হারায়।

বাজার চাঙ্গা করতে গত বছর আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও অধিকাংশ ব্যাংকই তা রাখতে পারেনি। তারল্য সংকট মেটাতে ১০ শতাংশের বেশি সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও গড়ে ১১ শতাংশ। বেশি লাভের জন্য অনেকেই মন্দার বাজার ছেড়ে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। পুঁজিবাজারে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

খেলাপি ঋণ বাড়ায় ও পুঁজিবাজারে লোকসানের কারণে হালনাগাদ হিসাবে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফা গড়ে ১০ শতাংশ কমেছে। তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ১৭টির মুনাফা আগের বছরের চেয়ে কমেছে। আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি দেওয়ায় অন্তত ১১টি ব্যাংক বড় ধরনের তারল্য সংকটে রয়েছে, যাদেরকে ৩১ মার্চের মধ্যে ঋণ ও আমানত সমন্বয় করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া ২০টি ব্যাংকের হাতে বিনিয়োগযোগ্য তারল্য প্রায় নেই বললেই চলে। মুনাফা কমে যাওয়ায় গত বছর ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাত (এনবিএফআই) যথাক্রমে ২২ ও ২৩ শতাংশ দর হারিয়েছে। এ বছরের শুরুতে দুটি খাতের শেয়ারের দর কিছুটা বাড়লেও ফেব্রুয়ারি থেকে আবার কমতে শুরু করেছে। তারল্য সংকট, মার্জিন ঋণে আটকে যাওয়া ও পুঁজিবাজারে লোকসানের কারণে ব্যাংক ও সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে। এর ফলে বিক্রির চাপ বেড়ে গিয়ে দরপতনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব বজায় রাখতে সুদহারে স্থিতিশীলতার পাশাপাশি বড় ও ব্র্যান্ডভ্যালুর কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। কিন্তু ২০০৯ সালে গ্রামীণফোন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে এ ধরনের কোম্পানি বাজারে আসেনি।

তিনি বলেন, ‘সূচকে ব্যাংক ও এনবিএফআই কোম্পানিগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হলেও এসব প্রতিষ্ঠান এখন ভালো অবস্থায় নেই। এগুলোকে সঠিক পথে চালাতে হবে। অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মিউচুয়াল ফান্ড। কিন্তু আমাদের এখানে এ খাতটিও বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। বাজারের স্বার্থে মিউচুয়াল ফান্ড খাতকেও ঠিক করতে হবে।’

ডিএসইর কর্মকর্তারা জানান, সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ডিএসইর দৈনিক লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ তলানিতে নেমে এখন ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে, যা গত বছরজুড়ে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। এটি ২০১০ সালে ছিল ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ৮০ শতাংশ। দেশটির পুঁজিবাজারের মোট লেনদেনের প্রায় ৩০ শতাংশ করে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর। সেখানে আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে দিনের লেনদেনে মিউচুয়াল ফান্ডের অবদান দুই শতাংশেরও কম। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারী-নির্ভর হয়ে পড়েছে পুঁজিবাজার।

২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের অংশ হিসেবে গত অক্টোবরে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনাদের কাছে ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হয়। এরপর বাজার পরিস্থিতি ভালো হবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। শেয়ার বিক্রি করে পাওয়া প্রায় হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা কর রেয়াতের সুযোগ থাকলেও ঝুঁকি থাকার কথা বলে বাজারে বিনিয়োগ না করে তুলে নিয়ে যান ৫৫ ব্রোকার। আবার যারা কর রেয়াতি সুবিধা নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই এখনো বিনিয়োগ করেননি। এর প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগকারীদের ওপর।

পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) ব্যাপক চাহিদা থাকার পরেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নামিদামি ও বড় মূলধনি কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সরকারের নির্দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সেই সঙ্গে এক যুগেও সরকারি ২৬ কোম্পানির একটিকেও তালিকাভুক্ত করতে পারেনি। এসব কারণে দেশের অর্থনীতির আকার যেভাবে বাড়ছে, তার তুলনায় বাজার মূলধন বাড়ছে না। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধনের অনুপাত ছিল ২৪ শতাংশ, যা ২০১৮ সাল শেষে ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

সম্প্রতি দেশের আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান। সেখানে পুঁজিবাজারে বৈচিত্র্য ও গভীরতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বাজারে বড় করপোরেট হাউসের সংখ্যা যে কম, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে বলেছেন তিনি। এ ছাড়া পুঁজিবাজার সম্প্রসারণে নতুন ও বহুমুখী কোম্পানির তালিকাভুক্তির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়েছে।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুসা বলেন, সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি তারল্য সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ কমবে। তা ছাড়া সামনে বড় মূলধনি কোম্পানির বাজারে আসার সম্ভাবনাও কম। কারণ দেশের বড় কোম্পানিগুলো জবাবদিহিতার আওতায় আসতে চায় না, মুনাফাও শেয়ার করতে চায় না। আবার আইন থাকলেও তাদেরকে তালিকাভুক্ত হতে বাধ্য করা হচ্ছে না- এটা একটা সমস্যা। যদিও অন্যান্য দেশে এ ধরনের কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: