২২ জুলাই ২০১৯ সোমবার, ০১:৪৬ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড অবসায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য লিকুইডেটরও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমানতকারীরা আশায় আছে তাদের অর্থ ফেরত পাওয়ার। বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার আশা করছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যালান্সশিটের তথ্য বলছে, পিপলস লিজিংয়ের যে সম্পদ আছে, দায়ের পরিমাণ তার প্রায় আড়াই গুণ। অর্থাৎ আমানতকারীদের দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ পিপলস লিজিংয়ের নেই। এ বছরের মার্চশেষে প্রতিষষ্ঠানটির হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণও মাত্র ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পিপলস লিজিং নিয়ে তারা পেপার ওয়ার্ক করছে। এটি শেষ হলে দায়-দেনা ও সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ জানা যাবে। এরপর আদালতের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পিপলস লিজিংয়ের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ ও অগ্রিম। মোট ঋণ ও অগ্রিমের মধ্যে ১ হাজার ৩৫ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ। মেয়াদি এ ঋণের মধ্যে ২২৮ কোটি টাকার বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত রয়েছে। ৯১৭ কোটি টাকার বিপরীতে ঋণগ্রহীতার ব্যক্তিগত গ্যারান্টি ছাড়া কিছুই নেই।
তবে চলতি ২০১৯ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের পরিমাণ আরো ২০৬ কোটি টাকা কমেছে। মার্চ শেষে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকায়।
এ সম্পদের বিপরীতে চলতি হিসাব বছরের মার্চ শেষে পিপলস লিজিংয়ের দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা মেয়াদি আমানত। যদিও গত বছরের ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট দায় ছিল ৩ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৪ কোটি টাকা মেয়াদি আমানত।
সম্পদ ও দায়ের এ তথ্যই বলছে, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার মতো সম্পদ পিপলস লিজিংয়ের নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিপলস লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হুদা বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের প্রতিষ্ঠানে অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির দায়-দেনা ও সম্পদ নিরূপণের কাজ করছেন। আমরা তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করছি।
সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ প্রায় আড়াই গুণ হওয়ায় আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পাবে কীভাবে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কোম্পানি আইন অনুসারে অবসায়নের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের যতটুকু সম্পদ রয়েছে তা আনুপাতিক হারে আমানতকারীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির দুরবস্থার জন্য দায়ী উদ্যোক্তা ও পরিচালকদেরও আইনের আওতায় এনে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুযোগ রয়েছে। যদি বিদ্যমান সম্পদ থেকে সম্পূর্ণ দায় মেটানো সম্ভব না হয় তাহলে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা দিয়ে আমানতকারীদের দায় মেটানো হবে। তবে আদালতের নির্দেশনা এবং কোম্পানি আইন অনুসারে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে।
পিপলস লিজিংয়ের লিকুইডেটরের দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক এম আসাদুজ্জামান খান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে পেপার ওয়ার্ক করছি। এটি শেষ হলে প্রতিষ্ঠানটির দায়-দেনা ও সম্পদের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হবে। তখন আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেভাবে কাজ করব।
পিপলস লিজিংয়ে আমানত রয়েছে অনেক ব্যাংকের। প্রতিষ্ঠানটির ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের আমানত রয়েছে ৪১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ৩৮ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৩৯ কোটি, ইউসিবির ২৫ কোটি, বিডিবিএলের ৫ কোটি, আইএফআইসির ১৫ কোটি ও কমার্স ব্যাংকের ১৪৩ কোটি টাকা। এছাড়া রূপালী ব্যাংকেরও ১২৯ কোটি টাকা আমানত রয়েছে পিপলস লিজিংয়ে।
এ আমানত ফেরত পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন,
পিপলস লিজিংকে দেয়া এ টাকা অনেক আগের। পরিশোধ করতে না পারায় এটি নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সুদের টাকা দেয়াও বন্ধ করে দেয়। এখন প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন হলে আমাদের পাওনা কীভাবে পাব, সে অপেক্ষায় আছি।
পিপলস লিজিংয়ে আমানত রয়েছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও। এর মধ্যে প্রিমিয়ার লিজিংয়ের আমানত রয়েছে ৪২ কোটি, ফার্স্ট ফিন্যান্সের ১১ কোটি, ফারইস্ট ফিন্যান্সের ২৮ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ২২৬ কোটি, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স ফান্ডের (বিআইএফএফএল) ৫৭ কোটি ও রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ৮ কোটি টাকা।
পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার কিনে বিপদে পড়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৯ জন সাধারণ বিনিয়োগকারীও। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারে বিনিয়োগ করে ঝুঁকিতে রয়েছে ৩৬৪ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি নিট দায় দাঁড়িয়েছে ৬৫ টাকা ৫৯ পয়সায়। যা এ বছরের মার্চ শেষে আরো বেড়ে শেয়ারপ্রতি ৬৭ টাকা ৬৬ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
শেয়ারপ্রতি দায় থাকার কারণে আইনানুসারে আপাতত বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মতিন পাটোয়ারী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, তবে অনেক সময় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের এমন কোনো সম্পদ রয়েছে যার বাজারমূল্য অনেক বেশি। পিপলস লিজিংয়ের যদি এমন কোনো সম্পদ থাকে তাহলে শেয়ারপ্রতি দায়ের পরিমাণ কমে আসবে। লিকুইডেটর কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটির দায়-দেনা চূড়ান্ত হলে তখন শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার। আর ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
অবসায়নের খবরে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে ভিড় করছেন। তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা, এ বিষয়ে কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইছেন। একজন বিনিয়োগকারী বলেন, ২০১১ সালে ১২২ টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার কিনেছিলাম। এখন এটি অভিহিত মূল্যেরও নিচে নেমে গেছে। কোম্পানিটি অবসায়নের কারণে আমরা শেয়ারহোল্ডাররা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ব।
পিপলস লিজিংয়ের ক্ষতিগ্রস্ত এসব বিনিয়োগকারীর বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের করণীয় কিছু নেই। এক্ষেত্রে সবকিছু কোম্পানি আইনের বিধান ও আদালতের নির্দেশনা অনুসারে সম্পন্ন হবে।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।