facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

ডুবছে জুট স্পিনার্স


১২ জুলাই ২০১৭ বুধবার, ১১:০৪  এএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


ডুবছে জুট স্পিনার্স

দুই সহোদর পরিচালক মোহম্মদ শামস-উল হুদা ও মোহাম্মদ শামস-উজ জোহার পারিবারিক দ্বন্দ্বে ডুবছে পাট খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি জুট স্পিনার্স লিমিটেড। টানা চার বছর ধরে লোকসান, চলতি মূলধন সংকট, বিদ্যুত্ ও পাটের দাম বকেয়া, বিসিকের কাছে দেনা, শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতা— সবমিলে দিন দিন আরো নাজুক হচ্ছে কোম্পানির অবস্থা। এ অবস্থায় কোম্পানির ভবিষ্যত্ নিয়েও শঙ্কা জানিয়েছে নিরীক্ষক। অন্যদিকে এক বছর ধরে কারখানা বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের ৪২ সপ্তাহের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর অবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক।

কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে তত্কালীন বাংলাদেশ জুট অ্যান্ড টুয়াইন মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামস-উল হকের উদ্যোগে জুট স্পিনার্স প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম পাটকল। একসময় কোম্পানিটির বেশ সুনাম ছিল। এমনকি এটি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পাটকলের পুরস্কারও পেয়েছিল। তাছাড়া আইএসও সনদপ্রাপ্ত কোম্পানিটির তৈরি করা পণ্য তুরস্ক, মিসর, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, স্পেন, চীন, ভারত ও উরুগুয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো।

মূল উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শামস-উল হক ২০১০ সালে মারা যাওয়ার পরে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে তার দুই ছেলে শামস-উল হুদা ও মোহাম্মদ শামস-উজ জোহার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর ফলে কোম্পানির আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণসহ পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ক্রমান্বয়ে পণ্যের বাজার হারানোর পাশাপাশি দুর্বল হতে থাকে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাও।

২০১১ হিসাব বছরে যেখানে কোম্পানির বিক্রি ছিল ৮৭ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৫ হিসাব বছরে তা ৫৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। তাছাড়া সর্বশেষ ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে জুট স্পিনার্সের নিট লোকসান হয়েছে ৭ কোটি ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬৯ টাকা। একই সঙ্গে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৭৬ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৩ টাকা। এত বড় লোকসান নিয়ে ভবিষ্যতে কোম্পানিটির এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান নিরীক্ষকও।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কাছে পাঠানো তথ্যানুসারে ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে কোম্পানির উত্পাদন বন্ধ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা ও কাঁচা পাটের মূল্যবৃদ্ধির কারণে টানা চার বছর ধরে কোম্পানিকে লোকসান গুনতে হয়েছে। এতে কোম্পানির চলতি মূলধন শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। তবে কোম্পানি এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পুরোদমে চেষ্টা করছে বলেও দাবি করা হয়।

তাছাড়া ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২০১৫-১৬ হিসাব বছরের বার্ষিক সাধারণ সভায় কোম্পানির দুরবস্থা কাটাতে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি, এসএমই ফাউন্ডেশন ও জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে নতুন মূলধন সংগ্রহ ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনয়ন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উজ জোহা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে পরিকল্পনার বাস্তবায়নে ব্যর্থ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানিয়েছে, দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের কারণেই ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব, কোম্পানির দুরবস্থা এবং শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়ার বিষয়ে জানতে জুট স্পিনার্সের চেয়ারম্যান মোহম্মদ শামস-উল হুদা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উজ জোহার সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। অফিসে গিয়েও তাদেরকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তারা কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফোনও রিসিভ করেন না বলে জানা গেছে।

এদিকে কারখানা বন্ধ থাকার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ শ্রমিক। গত ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত শ্রমিকদের ৪০ সপ্তাহের মজুরি বাবদ ৩ কোটি ৬০ লাখ, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ১৫ মাসের বেতন বাবদ ৬২ লাখ ৫০ হাজার, মজুরি কমিশনের এরিয়ার বাবদ ৩৭ লাখ, ঈদ বোনাস বাবদ ২৭ লাখ, ইনক্রিমেন্ট এরিয়ার ১০ লাখ এবং পদত্যাগ করা শ্রমিক-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটির ৭০ লাখ টাকাসহ মোট ৫ কোটি ৬৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকার দেনা বকেয়া রয়েছে জুট স্পিনার্সের। এ অবস্থায় মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা গত ৯ জুন বকেয়া বেতন-ভাতা ও ঈদ বোনাসের দাবিতে খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তাছাড়া ১০ জুন মিলের গেটে সভা করে ১৫ জুনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। এর মধ্যে ১৬ জুন থেকে সড়ক অবরোধ ও থালা-বাটি নিয়ে ভুখা মিছিলের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুন খুলনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডিসির নেতৃত্বে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ঈদের আগে শ্রমিকদের এক সপ্তাহ ও কর্মচারীদের এক মাসের বেতন বাবদ ১৮ লাখ টাকা দেয়া হয়। বাকি টাকা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করা হবে বলে জানায় মালিকপক্ষ। আর শ্রমিকদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিল। সভায় মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য মামলার সম্মুখীন হতে হবে বলে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করেনি তারা।

সিবিএ নেতারা জানান, দীর্ঘ প্রায় এক বছর মিলটি বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের মানবেতন জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বর্তমানে বেতন-ভাতাসহ কর্মীদের কাছে বকেয়া প্রায় ৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ব্যাংকের কাছে সুদে-আসলে কোম্পানির দেনাও ৪০ কোটি টাকায় ঠেকেছে।

জুট স্পিনার্স মিলের সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ রবিউল ইসলাম বলেন, মিলটি বন্ধের ঘোষণা করা হয়নি। মিলে এখনো হুইসেল বাজে, কয়েকজন শ্রমিক হাজিরাও দেন। পাট নেই, উত্পাদনও বন্ধ। সর্বশেষ গত এপ্রিলে মিলটির বকেয়া বিদ্যুত্ বিল পরিশোধ না করায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

এদিকে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে আবারো শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। সর্বশেষ গত রোববার জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ বেসরকারি পাট, সুতা, বস্ত্রকল শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সবুজ  জানান, মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণে পুরনো অনেক মিল একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে মালিকপক্ষের কিছুই আসে যায় না। বিপদে পড়ছেন শ্রমিকরা। তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধেও মালিকদের প্রবল অনীহা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বশেষ ৬৩ টাকা ৭০ পয়সায় জুট স্পিনার্সের শেয়ার হাতবদল হয়। লোকসানের কারণে ২০১২ সালের পর কোনো লভ্যাংশও পাচ্ছেন না এর শেয়ারহোল্ডাররা।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: