facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪

Walton

জাপানিরা ঘুমায় না!


০৩ জানুয়ারি ২০১৭ মঙ্গলবার, ০৫:০৩  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


জাপানিরা ঘুমায় না!

জাপানিরা ঘুমায় না-জাপানের মানুষসহ অন্যরা এমন কথাই বলেন। জৈবিকভাবে চিন্তা করতে গেলে কথাটি অবশ্যই ঠিক না। তবে এর একটি সাংস্কৃতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। আশির দশকে জাপানের অর্থনীতি যখন কল্পনাতীত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওই সময়টায় জাপানিদের দৈনন্দিন জীবনে এক ধরনের অস্থিরতা ছিল। মানুষের প্রতিদিনের রুটিন ছিল- কাজ আর বিশ্রাম। এরমধ্যে ঘুমের জন্য কোনো সময় রাখা হতো না।

সে সময়টায় জাপানে একটি এনার্জি ড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপনের স্লোগান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল- ‘আপনি কি ২৪ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করতে পারেন?/ ব্যবসায়ী! ব্যবসায়ী! জাপানি ব্যবসায়ী!’ তার মানে আপনি ২৪ ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করতে পারলে জাপানের বড় কোনো ব্যবসায়ী হয়ে উঠবেন। বিজ্ঞাপনটি ছিলো তৎকালীন জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি।

অনেকে তখন অভিযোগ করে বলেছিলেন: ‘আমরা জাপানিরা কাজ করার ব্যাপারে অত্যন্ত ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির।’ তবে এই অভিযোগই জাপানিদের গর্ব। এটাই তাদের মানবজাতির বাকি অংশ থেকে আলাদা করেছে। তারা প্রমাণ করেছে, মানবজাতির মধ্যে তারা শ্রেষ্ঠ।

জাপানে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ পাতাল ট্রেনে তন্দ্রা যায়। অনেক জাপানি দাঁড়িয়েই ঘুমান। আর এটা দেখে কেউ আশ্চর্যও হয় না।

তবে এই কাজপাগল মানুষগুলোর চরিত্রে এক ধরনের বৈপরীত্য আছে। কাজের কারণে বিছানায় পিঠ লাগানোর সুযোগ যারা পাননা, তারাই কিন্তু আবার কর্মক্ষেত্রে ঘুমাতে পছন্দ করেন। এ স্বভাবটাকে বলা হয় ‘ইনেমুরি’। মিটিংয়ে, ক্লাসে, লেকচারে যখন তখন ঘুমিয়ে যায় জাপানিরা। তাদের নারী, পুরুষ, শিশু- সবাই একই স্বভাবের।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিছানায় ঘুমানোকে যদি অলসতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে কর্মক্ষেত্রে বা কোনো অনুষ্ঠানে ঘুমানোকে কেন শ্রমবিমুখতা হিসেবে দেখা হবে না। যখন তারা জানেনই বাচ্চাদের রাতে ঘুমাতে না দিলে পরের দিন তারা ক্লাসে গিয়ে ঘুমাবে, তখন কোন জ্ঞানে তারা তাদের সন্তানদের রাত জাগিয়ে রাখেন?
সাধারণত আমাদের ধারণা, আমাদের পূর্বপূরুষরা স্বাভাবিক নিয়মেই রাতে ঘুমাতে যেতেন এবং সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই জেগে উঠতেন। তবে ঘুমের সময়টা আসলে কখনোই এতাটা সরল ছিল না- সেটা জাপান হোক বা অন্য কোথাও।

এমনকি বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের আগেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতো। তারা আড্ডা দিত, বিভিন্ন পানীয় পান করত এবং বিনোদনের জন্য আরো অনেক কাজই করতো। এজন্য তাদের তিরস্কারও করা হতো। তবে গবেষকদের- বিশেষ করে যুবক সামুরাইদের রাতজেগে পড়াশুনার জন্য উচ্চ মর্যাদা দেয়া হতো। অবশ্য এই প্রক্রিয়া বেশি ফলপ্রসূ ছিল না। কারণ, একদিকে বাতি জ্বালানোর জন্য বেশি তেল প্রয়োজন হতো। এছাড়া ক্লাসে লেকচারের সময় তারা ঘুমিয়ে পড়তেন।

তন্দ্রার বিষয়টি অবশ্য ইতিহাসে আলোচনা হয়নি বললেই চলে। বিভিন্ন সূত্র থেকে দেখা যায়, এটা তখন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। তন্দ্রার বিষয়টি একটি মজা করার ব্যাপার ছিল। কোনো বন্ধু তন্দ্রা গেলে অন্য বন্ধুরা তাকে নিয়ে মজা করতো।

জাপানে যখন কনফুসিয়াস মতবাদ এবং বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল তখন ভোরে ঘুম থেকে ওঠাকে এনটি গুন হিসেবে দেখা হতো। আদিকালে সরকারি কর্মচারীদের ভোরে শয্যাত্যাগ ছিলো একটি উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু মধ্যযুগে গিয়ে সমাজের সব স্তরে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠাকে উৎসাহিত করা হতো। তখন গুনী ব্যক্তিদের বর্ণনা করা হতো এভাবে- ‘তারা রাতে দেরিতে ঘুমাতে যায়, আর খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে।’

জাপানে ঘুমের ব্যাপারে আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে- যৌথ ঘুম। বাবা-মায়ের সঙ্গে একসাথে ঘুমায় ছেলেমেয়েরা। ব্রিটেনে ব্যাপারটা কিন্তু উল্টো। শিশুদের থেকে আলাদা হয়ে ঘুমাতে বলা হয় মা-বাবাদের, যাতে শিশুরা একাই ঘুমাতে শিখে। কিন্তু জাপানে অন্তত বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবারা তাদের সঙ্গে ঘুমান।
হতে পারে জাপানিদের এই সামাজিক প্রথার কারণেই তাদের অন্যের উপস্থিতে ঘুমাতে কোনো সমস্যা হয় না। অনেকে জানান, একা ঘুমানোর চেয়ে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানেই ভালো ঘুমাতে পারেন। এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায় ২০১১ সালের ধ্বংসাত্মক সুনামির পরে। তখন বেঁচে যাওয়া লোকদের আশ্রয়কেন্দ্রে একই স্থানে কয়েকশ জনকে ঘুমাতে হয়েছে। সেখানেও আরামে ঘুমিয়েছেন বলে জানান আশ্রিতরা।

তবে অন্যের উপস্থিতিতে এভাবে ঘুমানো শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কিছু কিছু পর্যায়ে ইনেমুরি আসলে ঘুমই না। এটা শুধু বিছানায় ঘুমানো থেকে তাই না, এটাকে আসলে গভীর তন্দ্রা থেকেও আলাদা করে দেখা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ইনেমুরিতে যারা অভ্যস্ত তাদের কর্মক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা হয় না কেন। এখানে গবেষক আর্ভিং গফম্যানের ‘সামাজিক পরিস্থির সঙ্গে সম্পৃক্ততার ধারণা’টি গুরুত্বপূর্ণ। ইনেমুরির বিষয়টি বুঝতে এই তত্ত্বটিও বুঝতে হবে। আমাদের শরীরি ভাষা এবং মৌখিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে আমরা মূলত কোনো না কোনো অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকি। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের মনোযোগকে দুইভাগে ভাগ করতে পারি: শক্তিশালী মনোযোগ এবং দুর্বল মনোযোগ।

ইনেমুরি মূলত আমাদের দুর্বল মনোযোগের অবস্থা। তাই কোনো একটি অবস্থায় মনোযোগ চলে গেলেও যখনই প্রয়োজন হয় তখন খুব দ্রুতই তা ফিরে আসতে পারে। শারীরিক ইঙ্গিত, শরীরি ভাষা, ড্রেস কোড এবং এ ধরনের যেকোনো উদ্দীপনার মাধ্যমে আমরা সহজেই শক্তিশালী মনোযোগের জগতে ফিরে আসতে পারি।

আর এ কারণেই হয়তো জাপানিদের ইনেমুরির স্বভাবটা হয়তো আলস্যে প্রবণতা হিসেবে দেখা হয় না। বরং এটা এখন জাপানিদের জীবনের একটি অনানুষ্ঠানিক অংশ হয়ে গেছে। তাই বলা যায়, জাপানিরা ঘুমায় না। তারা তন্দ্রাও যায় না। তারা যেটা করে তা হচ্ছে- ইনেমুরি। এটা অন্যগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণই আলাদা।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন:

বিশেষ প্রতিবেদন -এর সর্বশেষ