facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

ছিনতাই ঘটনায় বদলে যায় সাংসদ লিটন হত্যার তদন্তের মোড়


২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শনিবার, ০৭:০৭  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


ছিনতাই ঘটনায় বদলে যায় সাংসদ লিটন হত্যার তদন্তের মোড়

সুন্দরগঞ্জের ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় গত ১ ডিসেম্বর রাতে অস্ত্রের মুখে এক তরুণের মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয় তিন দুর্বৃত্ত। মোটরসাইকেলে আসা ওই দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে ঘটনাস্থলে পড়ে যায় পিস্তলের গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন। এর ৩০ দিন পর সেখান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সর্বানন্দ ইউনিয়নের সাহাবাজ গ্রামে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের সাংসদ মনজুরুল ইসলামকে (লিটন)।

সাংসদ মনজুরুল হত্যা মামলা তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, ওই ছিনতাই ঘটনার সূত্র ধরেই তাঁরা মনজুরুল হত্যারহস্য উন্মোচন করেছেন। দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে পড়ে যাওয়া ম্যাগাজিনের ছয়টি গুলি ও ছিনতাই হওয়া কালো রঙের সিম্ফোনি ডব্লিউ এক্সপ্লোরার এইচ ৬০ মডেলের মুঠোফোনই তাঁদের নিয়ে যায় হত্যাকারীদের দ্বারপ্রান্তে।

দৈনিক প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, গাইবান্ধা শহর থেকে একটি পাকা সড়ক চলে গেছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরের দিকে। ওই সড়ক ধরে ১৬ কিলোমিটার গেলে মূল সড়কের পাশেই নতুন বাজার। বাজারের লাগোয়া মূল সড়কের পাশেই বাড়ি মো. ফাহিম মিয়ার (২০)। তিনি গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের ছাত্র। ১ ডিসেম্বর তাঁর মুঠোফোনটিই ছিনিয়ে নিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।

ফাহিমের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাড়িতে কথা হয়। তিনি বলেন, ওই রাতে (১ ডিসেম্বর) বাড়ির সামনে মুরগির খামার পাহারা দিচ্ছিলেন তিনি। রাত সোয়া ১২টার দিকে তিনি পাকা রাস্তা ধরে একটু সামনে একটি বন্ধ টং দোকানের সামনে বসে মোবাইল ফোন ঘাঁটছিলেন। হঠাৎ গাইবান্ধার দিক থেকে আসা একটি মোটরসাইকেল তাঁর সামনে দাঁড়ায়। মোটরসাইকেলে থাকা তিনজনের মধ্যে দুজন নেমে আসে। ‘দেখি তোর কাছে কী আছে’ বলে একজন তাঁর শার্টের পকেটে হাত দেয়। কিছু না পেয়ে পাশের জনকে বলে ‘ভাই, গুলি করে দেই’। অন্যজন বলে, ‘না’। এরপর তারা মুঠোফোনটি চাইলে তিনি দিয়ে দেন। তারা ফোনটি নিয়ে চালু থাকা মোটরসাইকেলে করে সুন্দরগঞ্জের দিকে চলে যায়।

ফাহিম বলেন, ছিনতাইকারীরা চলে যাওয়ার পর তিনি কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থাকেন। এরপর সঙ্গে থাকা টর্চলাইট জ্বালালে তিনি দেখেন, পাকা রাস্তার ওপর কালো একটা কিছু পড়ে আছে। হাতে নিয়ে দেখেন ভেতরে গুলি। তিনি রাতেই ঘটনাটি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সবুজ চৌধুরীকে জানালে তিনি পরদিন বিষয়টি পুলিশকে জানান। পুলিশ এসে ম্যাগাজিনটি নিয়ে যায় এবং ঘটনার বর্ণনা লিখে নেয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুন্দরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোরওয়ার্দী ২ ডিসেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তৈরি করেন জব্দ তালিকা। ওই জব্দ তালিকায় বলা হয়েছে, একটি কালো রঙের পুরাতন ব্যবহার করা ৭.৬৫ পিস্তলের ম্যাগাজিন। এর ভেতর ৭.৬৫ এর ছয়টি সতেজ গুলি ছিল। এর মধ্যে দুটি গুলির পেছনে ক্যাপে ইংরেজিতে ৭.৬৫ বিটি .১২ এসআরবি লেখা আছে। অন্য চারটি গুলির পেছনের ক্যাপে ইংরেজিতে কেএফ ৭.৬৫ লেখা আছে।

নতুন বাজারেই থাকেন নিহত সাংসদ মনজুরুলের একসময়ের একান্ত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (সুজা)। সাংসদ মনজুরুল হত্যার ১০ দিন পর ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এই চেয়ারম্যান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি জানান গাইবান্ধা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন মিয়াকে।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মনজুরুল হত্যার পর ঘটনা তদন্তে পুলিশের বিশেষ তদন্ত দল, র‌্যাব, পিবিআই ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁর কাছে আসেন। তখন একদিন তিনি কথা প্রসঙ্গে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি আনোয়ার হোসেন মিয়াকে জানিয়ে খতিয়ে দেখতে বলেন।

পিবিআই কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি জানতে পারেন, ম্যাগাজিনে ৭.৬৫ বোরের গুলি ছিল। বিষয়টি তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। কারণ, সাংসদ মনজুরুল হত্যার পর গুলির উদ্ধার করা খোসাগুলোও ছিল ৭.৬৫ বোরের। এরপর ছিনতাই হওয়া মুঠোফোনটির আইএমইএ নম্বর সংগ্রহ করে ট্র্যাক করে তা খুঁজে বের করেন।

ছিনতাই হওয়া মুঠোফোনটি ব্যবহার করছিলেন মো. মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি গাইবান্ধা শহরের পুরাতন ব্রিজ এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে গত ৩১ জানুয়ারি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন, তিনি মো. রায়হান মিয়া নামে পরিচিত একজনের কাছ থেকে মুঠোফোনটি আড়াই হাজার টাকায় কিনেছেন।

রায়হানের কাছ থেকে মুঠোফোনটি কেনার কথা জানিয়ে মুজাহিদুল মুঠোফোনে বলেন, তিনি ৩১ জানুয়ারি পিবিআইয়ের কার্যালয়ে এবং পরবর্তী সময়ে থানায় গিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি আর কিছু বলবেন না বলে ফোন কেটে দেন।

ওই রায়হানের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর বাজার এলাকায়। ওই বাজারে তাঁর একটি দোকান আছে। বাজার থেকে পাঁচপীর এলাকার দিকে যাওয়া সড়ক ধরে কিছুটা এগোলে তাঁর বাড়ি। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, একদিন রানা (আনারুল ইসলাম রানা, সাংসদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া) তাঁর দোকানে এসে বলেন, খুব টাকার দরকার। তিনি টাকা দিতে না চাইলে মুঠোফোনটি রেখে এক হাজার টাকা দিতে অনুরোধ করেন। তিন দিন পর টাকা ফেরত দিয়ে মুঠোফোন নিয়ে যাবে বলে জানান। তিন দিন পর রানা এলেও টাকা দিয়ে মুঠোফোন ফেরত না নিয়ে আরও এক হাজার টাকা চান। বিনিময়ে মুঠোফোনটি রেখে দিতে বলেন। তিনি তখন ফোনটি রেখে দেন। এর কিছুদিন পর মুজাহিদের সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাঁর কাছ থেকে ফোনটি আড়াই হাজার টাকায় কেনেন।

রায়হান বলেন, রানার সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল, অনেকটা বন্ধুর মতো। সে কারণেই তিনি ফোনটি নিয়েছিলেন। রানার সঙ্গে তিনি কয়েকবার মেহেদীকেও দেখেছেন। কিন্তু তাঁকে তেমন চিনতেন না। মুজাহিদকে নিয়ে যাওয়ার পর একদিন পিবিআই দোকানে এসে তাঁকেও খোঁজে। জানতে পেরে তিনিই পিবিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে গাইবান্ধা শহরে পিবিআইয়ের কার্যালয়ে যান। সেখানে তাঁকে তিন দিন আটক রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন মিয়া বলেন, রায়হানের বক্তব্য অনুযায়ী রানা ও মেহেদীর বিষয়ে তিনি খোঁজখবর শুরু করেন। তখন এলাকাবাসীর কাছ থেকে তাঁরা জানতে পারেন, এরা সাবেক সাংসদ কাদের খানের দেওয়া ফ্রিডম চিতা মডেলের একটি মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন। এরই মধ্যে তিনি তাঁর পরিচিত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, এই গুলি গাজীপুরের জয়দেবপুরের অস্ত্র কারখানায় তৈরি হয় এবং এলপিআর, পিআরএলে থাকা বা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা ছাড়া কেউ এই গুলি পাওয়ার কথা নয়। তখনই তিনি নিশ্চিত হন যে ঘটনার সঙ্গে আবদুল কাদের খান সম্পৃক্ত। বিষয়টি তিনি ঢাকায় পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান।

পুলিশ বলেছে, এরপর বিষয়টি ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এরপর পুলিশ ছিনতাইয়ে জড়িত রানা, মেহেদী ও শাহিনের ফোনের কল তালিকা বিশ্লেষণ করে ও আড়ি পেতে কাদের খানের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের প্রমাণ পায়। পরে সাংসদ মনজুরুল হত্যার ব্যাপারে কাদের খানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়ার পর তাঁকে বগুড়া শহরের রহমান নগরের বাড়িতে ছয় দিন ‘নজরবন্দী’ রাখে পুলিশ। গত মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে বুধবার ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: