facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

চাঁদের কান্না


২৫ আগস্ট ২০১৭ শুক্রবার, ০৬:১৫  পিএম

হারুন রশিদ

শেয়ার বিজনেস24.কম


চাঁদের কান্না

 

ভৈরবের জলে আমরা ভেসে ভেসে চলছি। ঠিক কতজন তা বলতে পারবোনা, এখন আমরা গোনা গুনতির বাইরে। আমরা ভাসছি ঝাঁকে ঝাঁকে কাতারে কাতার। ভাটার টানে চলছি, কচুরিপানাও আমাদের সাথে ভেসে চলছে। আমার বাম পাশে একটা ছোট্ট শিশু তার কচি হাতের স্পর্ষ পাচ্ছি।

ডান পাশে স্বশ্রুধারী একজন নানা দাদার বয়সি তাঁর লম্বা দাড়ির পরশ বুলাচ্ছে। আকাশে চাঁদ দুলছে। চাঁদ আবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। চাঁদের সুকরুণ সুর শুনতে পাচ্ছি। চাঁদের চোখের জল জোস্নার সাথে মিশে টুপ টাপ নদীতে পড়ছে। আমার গায়েও কয়েক ফোটা এসে পড়ে।

নিশুতি রাত, নদীস্রোতের কলকল শব্দ। দূরে একটানা ঠা ঠা শব্দ ভেসে আসছে। আবার দ্যুম ধ্যুম শব্দ হচ্ছে। গাঙ্গের উচ্ছুড় পানিও ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আল্লার ভারী রহমত যে আমাদের এখন ভয় লাগছেনা, আমরা এখন ভয়ের চৌহদ্দীর বাইরে। মনে হয় আরো কিছু বাঙ্গালীদের চাঁদের কান্না শুনতে পাঠানো হচ্ছে।

পানি দাবড়িয়ে জোড়া গানবোট চলছে। এক ঝাঁক আলোর রোশনাই আমাদের উপর বার কয়েক চোখ বুলিয়ে গেলো। প্রবল শব্দ গর্জন আর ঢেউয়ের তোড়ে একবার আমরা ঢেউয়ের চুড়ায় উঠছি আবার নীচেয় নামছি। আমরা কিন্তু ডুবছিনা, ভারী একটা মজার খেলা। ঢেউয়ের দোলায় আমরা একজন আর একজনের গায়ে গিয়ে পড়ছি। লম্বা রেশমি চুল আমার মুখে জড়িয়ে গেলো, তার কোমল স্পর্ষ পেলাম, ঠিক সালমার মতো। সালমা এখন কোথায়? ওকি গগন বাবু রোডে না গৌরম্ভায় তার দাদা বাড়ি? সালমা এখন কী ভাবছে? ও কী উল দিয়ে এখনও আমার জন্য সোয়েটার বুনছে? ও এখন কী করবে, ও কী আর কাউকে ভালবাসবে না সারাজীবন আমার অপেক্ষয় থাকবে। সে কী তার ছেলেমেয়েদের কখনো আমার কথা বলবে? হয়তো এসব কিছু সে একদিন ভূলে যাবে, তার সব শোক স্তিমিত হয়ে আসবে।

আমরা ভৈরব ছাড়িয়ে রূপসার ঘোলা জলে। ওপারের ডক কোম্পানি সব ভয়ে নিসাঃড়, হাতুড়ি পেটার কোন শব্দ ভেসে আসছেনা। একটা হাভাতে মাছ আমার বুকের কিছু মাংশ খাবলে নিয়ে গেলো। গনীমতের মালে পানিতে এদের হক আছে। আশেপাশে পরপারের সাথীদের হদীশ দেখছিনা। আমি এখন দলছুট। স্রোতে ভাসিয়ে আমাকে মোটা তারের দুই কাছির উপরে এনে ফেলেছে। খুলনা শিপইয়ার্ডের কিনারে মেরামতের অপেক্ষায় গ্রাফি করা কার্গোর সাথে গলাগলি করে বাঁধা বার্জের পিছনে কাছিতে উরু ও হাত পেঁচিয়ে গেলো।।

ভাটাতে পানি নীচে নেমে আসছে, আমি এখন শুণ্যে তারের উপর শুয়ে আছি। স্রোতে আমি শুণ্যে কাছির উপরে দুলে দুলে উঠছি। সুবেহসাদেক হয়ে এলো; ওপার জাবুসার চরের হোগলা বন থেকে হট্টিটিটি আর ডাহুক পাখির ডাক ভেসে আসছে। আমার পেট ও মুখে তরল মল ফর ফরাৎ করে পড়তে শুরু করে। কিছু পরে ঢব ঢব করে কঠিন বিষ্ঠা মাটির ডেলার মত আমার নাকে মুখে পড়তে থাকে। তারপর ছড়বড়িয়ে পানি পড়তে থাকে। আমার গা মুখ গুয়ে লেপ্টে যায়। দুই কাছির মাঝখানে আমি এ্যাক্রোবেটদের মত ঝুলছি। পেটের ফুটো থেকে সরু পেচানো নাড়ি বেরিয়ে নীচের পানিতে অবগাহন করছে। গরম মূত এসে আমার চোখমুখ ভিঝিয়ে দিলো।

এক কিশোরের গলার আওয়াজ ভেসে এলো, ওরে আল্লা টাট্টির নামায় এউগ্গা লাশ । মুখে ছাগুলে দাড়ি খড়ম পায়ে লোহর পাটাতনে খটাস খটাস শব্দ করে মেছওয়াক করতে করতে একজন বয়সিলোক বার্জের কিনারে উঁকি মেরে দেখে।

বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ, সাড়াশব্দ নেই। সারেং-সুখানিরা র্নিঝঞ্জাট বাহ্যখানা চায়। এবার একজন ষন্ডামত, হাতে তার বাঁশের লগি। লগি দিয়ে সে আমার কোমরের দিকে খুব জোরে গুতা মারে। আমার কোমরের হাড় মট্টাশ করে ভেঙ্গে লগিটা মাংশের ভিতর ঢুকে গেলো।। লগিটা আমার শরীর থেকে জোর দিয়ে টেনে বের করে, সে দ্বিতীয়বার গুতা মারার প্রস্তুতি নেয়। এবার ছাগুলে দাড়ি লোকটি খেকিয়ে ওঠে, হালার পূত তুই হইলি এড্ডা আস্ত পাঢা, তোর দেলে একটু দয়ামায়া নাই এইডা মড়ী হইলেও তো মানুষ!
অবমুক্ত হয়ে আমি আবার ভাসতে থাকি।

আমার লঞ্চের সহযাত্রীরা সব এখন কে কোথায়?
আমরা সব লঞ্চের যাত্রীরা এক সঙ্গে পাক ওয়াতন সুরক্ষার হায়নাদের হাতে ধৃত হয়ে খালিশপুর স্কুলের পিছনে চরেরহাটে ভৈরব নদের পাড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হবার অপেক্ষায় সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়েছিলাম।
একজন সিপাই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো, তোম লোক স্টুডেন্ট হ্যায়?
আমি সত্যই বললাম, আমি সিটি কলেজে আইএসসি পড়ি।
নাম বাতাও।
আসাদ।
পাশে দাড়ানো আর এক সিপাই তার বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মেরে চিৎকার করে বলে শালা মাদারচোদ মুক্তি হ্যায়।
প্রচন্ড ব্যাথা আর যন্ত্রনায় আমি পেট চেপে বসে পড়ি, আমার দম বন্দ হয়ে আসে।

যুবতী মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে দাড়ানোর হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলো! তাদেরকে পাজাকালো করে নিয়ে একটা ত্রিপল ঢাকা লরীতে ঢোকানো হচ্ছিলো। কাঁধে ব্যাচ আটা ধর্ষনে উদগ্র কয়েকজন হানাদার লরীর ভিতর উঠে পড়ে। একটি কিশোরী কতইবা বয়েস বারো-তেরো, ঠিক আমার বোন ছকিনার মত, লাল ফিতার দুটি চুলের বিনুনি। লঞ্চে তাকে দেখেছিলাম গুড় দিয়ে পাউরুটি চিবোচ্ছিলো আর তার মায়ের গায়ে এলিয়ে পড়ে বকর বকর করছিলো। তার ছোট ভাইটিকে পাউরুটি ছিড়ে হাতে দিচ্ছিলো। একজন সিপাই ঢ্যাঙ্গামত বেশখানিক লম্বা কিশোরিটিকে জাপটে ধরে।
সে আর্তচিৎকার দিয়ে, সিপাইটির লম্বা হাতের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে দেৌড় দেয়। আর একজন সিপাই পাকানো গোফ, দৌড়ে মেয়েটিকে ধরে তার গালে একটি চড় মারে, মেয়েটি কঁকিয়ে উঠে শব্দহীন হয়ে যায়। হয়তো কিশোরীর এটাই শেষ শব্দ। মেয়েটিকে হায়নাটি পাজাঁকোলে করে লরীর ভিতর ছুড়ে মারে। যে ভাবে কুলিরা আলুর বস্তা লরীতে লাট দেয় সেই ভাবে মেয়েদের ধরে নিয়ে ত্রিপল ঢাকা লরীতে লাট দেয়া হচ্ছিলো। মেয়েটির মাকে কয়েকজন সিপাই জাপটে ধরে সর্বসম্মূখে দলাই-মুচড়াই করে, টেনে তাঁর অর্ন্তবাস খুলে ফেলে। তারপর তাঁকেও লরীতে লাট দেয়া হয়। মেয়েটির ছোট ভাই কতইবা বছর পাঁচ, একটা দড়িভরা হাফপ্যান্ট ও একটা লাল স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, লিকলিকে দুটি পা সে আমার বা দিকে দাড়িয়েছিলো। সে আমার হাত জোরে আকড়ে ধরে; তার আঙ্গুলগুলি যেন ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে আমার হাতের ত্বকে বসে যায়। আমি তার দিকে একটু নীচু হয়ে তাকাই। তার শ্যামল মুখমন্ডল হঠাৎ অদ্ভুৎ রং ধারণ করে। এমন রং জন্মের পর আমি এই দুনিয়ায় কখনো দেখেনি। শিশুটির আঙ্গুলগুলো কামারশালা।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: