০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ শনিবার, ১০:৫৫ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতের নিয়মনীতি স্থূলভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বদলে অবনতি হয়েছে।
গুলশানের একটি হোটেলে শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কী করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সভায় বক্তাদের কাছ থেকে নতুন সরকার গঠনের পর দেশের ব্যাংকিং খাত ঢেলে সাজানোর জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে।
সভার প্রধান অতিথি ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ব্যাংকিং খাতের নিয়ম লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “দেশের ভিতরে আমি এই প্রথম দেখেছি সাধারণ মানুষ, ব্যাংকের আমানতকারীরা প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে কোন ব্যাংকে রাখলে তার আমানত নিরাপদ থাকবে। এর আগে কখনোই আমি এই প্রশ্নের সম্মূখীন হইনি।”
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমস্যার বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান বহন করতে হয় এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এবং কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী এ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অনৈতিকভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে যে ঋণ নেন সে ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যান।”
তবে সব রাজনৈতিক প্রভাবশালীই ঋণ খেলাপী হন না বলে মন্তব্য তার।
অন্যদিকে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ঠিক না করেই বেসরকারি ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে মত দেন তিনি।
বাংলাদেশ বাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ “আশির দশকে যখন প্রথম দিকে বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, তখন আমাদের বড় ভূল হয়েছিল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ঠিক না করেই ব্যাংকগুলোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেই খেসারত আমাদের দিতে হয়েছিল পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে। দেখা গেল ওই বেসরকারি খাতের ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাদের নিজেদের ব্যাংকের ৩০ শতাংশের মতো আমানত নিজেরাই ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং তার অধিকাংশই খেলাপী হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “এটি একটি সাংঘাতিক বিষয়। নিয়মকানুন ঠিক না করে এক চেটিয়া ব্যবাসার সুযোগ করে দেওয়া মানে পুরো অর্থনীতিকে কিছু কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি করে ফেলা। এটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।”
সভায় বাংলাদেশ বাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের সরকারি ব্যংকগুলো জবাবদিহি নয়। এটা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।”
ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতাকেই দায়ী করে তিনি বলেন, “দেশের ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতিতে আমি খুশি নই, আবার আতংকিতও নই। তবে এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার কারণে হয়েছে বলে আমি মনে করি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এটা ঠিক করা সম্ভব। আমি মনে করি আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর এখনো ধ্বংসের পথে যায়নি।”
সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, “দেশে এখন ব্যাংকিং খাতই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু এ সমস্যা হঠাৎ করে হয়নি, ধারাবাহিকভাবে হয়েছে। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এখন।
“একটি ব্যাংকের পরিচালন মুলধনের মাত্র ৭ থেকে ৯ শতাংশ অর্থের যোগান দেয় মালিকপক্ষ। আর ৯০ শতাংশের মতো যোগান দেন আমানতকারীরা। কিন্তু পরিচালনা বোর্ডে যারা নির্বাচিত হন তারা মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষা করেন। ৯০ শতাংশের মালিক জনগণের পক্ষে কেউ থাকে না।”
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তিনি নতুন সরকার গঠিত হওয়ার ব্যাংক খাতে একটি সমীক্ষা করে সংসদে আলোচনা করাসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তিথ্যের ভিত্তিতে জানান গত দশবছরে ব্যাংক খাতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন চাহিদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে বেসিক ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামি ব্যাংকের মূলধন আশঙ্কাজনকভাবে কম।
২০১৮ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। এটা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দেশে অতিরিক্ত ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার সমালোচনা করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, মেক্সিকোর অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ৭.৪ গুণ বেশি হওয়ার পরও তাদের মাত্র ৪৭টি ব্যাংক, আর বাংলাদেশে ৫৪টি। সম্প্রতি আরও কয়েকটি অনুমোদন দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতকে এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে ২০০৩ সালের ব্যাংক লোন কোর্ট এবং ১৯৯৭ সালের ব্যাংক দেউলিয়া আইনের বাস্তবায়ন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাসেল-৩ বাস্তবায়নের উপযোগী করা এবং যেসব ব্যাংক বছরের পর বছর ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে সেসব ব্যাংকের পুন:অর্থায়ন বন্ধকরাসহ সাতটি সুপারিশ তুলে ধরা হয় প্রবন্ধে।
সভার সঞ্চালক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “দেশের বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই কঠিন সময় থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে আর্থিক খাতকে নিষ্কৃতি দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের এমন প্রণোদনা সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা ব্যাংকিং খাত সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে সহায়তা করবে।”
তিনি আগামী নির্বাচনের পর একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।