২৬ জানুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার, ০৯:৫৬ এএম
হুহু করে বাড়তে থাকা সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে। গত ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট দুই হাজার ৬৫১ কোটি টাকা পেয়েছে সরকার। আগের মাস নভেম্বরে বিক্রি হয় তিন হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একক কোনো মাসে এত কম সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি।
ব্যাংক আমানতে সুদহার বৃদ্ধিই সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার মূল কারণ বলে সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন।
কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে ব্যাংক আমানতের সুদহারে অনেক বেশি ব্যবধান তৈরি হওয়ায় সঞ্চয়কারীরা সঞ্চয়পত্রের দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন। ব্যাংকের সুদহার তলানিতে ঠেকায় অনেকে ব্যাংক থেকে বিভিন্ন মেয়াদি আমানত ভেঙেও সঞ্চয়পত্র কেনেন। তিন-চার বছর ধরে চলতে থাকা এ প্রবণতা গত কয়েক মাস কমেছে। নভেম্বরের পর থেকে তুলনামূলকভাবে আগের কয়েক মাসের চেয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে গতি কমেছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে হওয়ায় সুদ ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ কারণে বেশ কিছুদিন ধরে সরকারও চাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কিছুটা কম হোক। তবে সুদহার কমাতে না পেরে বিকল্প হিসেবে কৌশলে সঞ্চয়পত্রের সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে করে অনেকে ব্যাংকে আগ্রহীরা গিয়েও সঞ্চয়পত্র পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিক্রি কমার এটিও অন্যতম একটি কারণ বলে জানান ব্যাংকাররা।
চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসেই পুরো বছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮০ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম মাস জুলাইতে এসেছিল পাঁচ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। পরবর্তী মাস আগস্টে তিন হাজার ৯৭৫ কোটি, সেপ্টেম্বরে তিন হাজার ৬৬৬ কোটি, অক্টোবরে চার হাজার ৬২০ কোটি ও নভেম্বরে তিন হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা বিক্রি হয়। এক মাসের ব্যবধানে ১২শ` ৬ কোটি টাকা কমে ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৫১ কোটি টাকায় নেমেছে। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিক্রি গিয়ে ঠেকে ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারের মোট ঋণ রয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৬০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছর ব্যাংক থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। তবে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি অর্থ আসায় গত ৬ মাসে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ ৭ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা কমে ডিসেম্বর শেষে ৮১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকায় নেমেছে। গত অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উল্টো ১৮ হাজার ২৯ কোটি টাকা পরিশোধ করে সরকার।
ব্যাংকের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে সুদহারের ব্যাপক ব্যবধানে সঞ্চয়কারীরা উপকৃত হলেও সরকারের সুদ ব্যয় অনেক বেড়েছে। ব্যাংকে সুদহার কিছুটা বৃদ্ধির পরও গত ডিসেম্বরে সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি ঋণ নিয়েছে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদে। দশ বছর মেয়াদি ঋণে ব্যয় হয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। অথচ সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিতে এখনও সরকারকে ১১ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে করে সুদ পরিশোধে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সরকারের ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ২৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ব্যয় হয় দুই হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম তিন মাসেই সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৭১ শতাংশের বেশি।
ব্যাংক খাত-সংশ্নিষ্টরা জানান, কয়েক বছর ধরে ব্যাংক আমানতে সুদহার ব্যাপকহারে কমে গড়ে ৫ শতাংশের নিচে নামলেও সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১১ শতাংশের বেশি রয়েছে। বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চয়পত্রে সুদ কমাতে সরকার উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন কারণে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করতে পারেনি। আবার আশানুরূপ ঋণ চাহিদা না থাকায় অধিকাংশ ব্যাংকের কাছে ব্যাপক উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। তবে কয়েক মাসে পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে আমদানিতে ২৮ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হলেও রফতানিতে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং রেমিট্যান্সে সাড়ে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে চাপে ফেলেছে। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এতে বেশি তারল্যের কারণে বেশিরভাগ ব্যাংক এখন টাকার টানাটানিতে পড়েছে।
নগদ টাকার টানাটানি মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো এখন আমানতের সুদ বৃদ্ধি করছে। মেয়াদি আমানতে ৮ শতাংশ বা তার বেশি সুদ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। কয়েক মাস আগেও যা ৬ শতাংশের নিচে ছিল। এছাড়া সঞ্চয়ীসহ অন্য সব ক্ষেত্রেও সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহারও বাড়তে শুরু করে। সুদের ব্যবধান কমে আসার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমছে।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।