facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪

Walton

একীভূত ৮ কোম্পানির ৬টির মুনাফাই নিম্নমুখী


১৭ নভেম্বর ২০১৭ শুক্রবার, ০৩:৫১  পিএম

শেয়ার বিজনেস24.কম


একীভূত ৮ কোম্পানির ৬টির মুনাফাই নিম্নমুখী

কোম্পানির ব্যবসায়িক দক্ষতা ও মুনাফা বাড়াতে একীভূতকরণ বিশ্বব্যাপীই স্বীকৃত প্রথা। একই লক্ষ্যে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আটটি কোম্পানির সঙ্গে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়েছে। যদিও এর ফলাফল খুব একটা ভালো হয়নি। ছয়টি কোম্পানির মুনাফা নিম্নমুখী এবং মুনাফায় উন্নতি করতে পেরেছে মাত্র দুটি কোম্পানি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে আলাদা মালিকানার একই খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যেই একীভূত হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ ধরনের একীভূতকরণের পর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন দক্ষতার সুফল দেখা যায় কোম্পানির মুনাফায়। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টোটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো কোম্পানি একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, তার অধিকাংশই একই গ্রুপের ভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠান।

বেক্সিমকো গ্রুপ : একীভূতকরণে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। তাদের হাত ধরেই দেশে একীভূতকরণের সংস্কৃতি চালু হয়। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে বেক্সিমকো টেক্সটাইলস লিমিটেডের সঙ্গে বেক্সিমকো গ্রুপের তালিকাভুক্ত কোম্পানি পদ্মা টেক্সটাইল মিলস, বেক্সিমকো ডেনিমস ও বেক্সিমকো নিটিং একীভূত হয়।

পরবর্তীতে ২০১১ সালে একীভূত বেক্সিমকো টেক্সটাইলস আবার গ্রুপের মূল কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে একীভূত হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে গ্রুপের আরো কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশ অনলাইন লিমিটেড, ঢাকা সাংহাই সিরামিক (তালিকাবহির্ভূত), শাইনপুকুর হোল্ডিংস ও বেক্সিমকো ফিশারিজকে বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে একীভূত করা হয়। এসব একীভূতকরণের পর বেক্সিমকো লিমিটেড একটি কনগ্লোমারেটে পরিণত হয়। তবে মুনাফায় এর সুফল দেখা যায়নি।

২০১০ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতি শেয়ারের বিপরীতে মুনাফা (ইপিএস) ছিল ৪২ টাকা ২২ পয়সা। ২০১১ হিসাব বছরে তা কমে দাঁড়ায় ২০ টাকা ৫০ পয়সায়। ২০১২ হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৮৩ পয়সা, ২০১৩তে যা ৬৭ পয়সায় নেমে আসে। এরপর ইপিএস বাড়লেও কোনো হিসাব বছরেই তা ২ টাকা ছাড়ায়নি।

বেক্সিমকো গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে একই খাতের কোম্পানি বেক্সিমকো ইনফিউশন্সকে একীভূত করা হয় ২০০৫ সালে। এক্ষেত্রে দুটিই ওষুধ শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তবে একীভূতকরণের পর এখানেও নিরাশ হতে হয় শেয়ারহোল্ডারদের।

২০০৫ হিসাব বছরে বেক্সিমকো ফার্মার ইপিএস ছিল ৬ টাকা ৩৬ পয়সা, যা পরের বছর কমে ৪ টাকা ১১ পয়সায় দাঁড়ায়। এরপর কোনো হিসাব বছরেই আর একীভূতকরণ-পূর্ব ইপিএস দেখাতে পারেনি বেক্সিমকো ফার্মা।

বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ বলেন, কোম্পানির আর্থিক অগ্রগতির বিষয়টি বিবেচনা করেই বিভিন্ন সময়ে গ্রুপের কোম্পানিগুলোকে একীভূত করা হয়েছিল। সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পাশাপাশি কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট ও পর্ষদেরও প্রত্যাশা ছিল, একীভূতকরণের পর কোম্পানির মুনাফা বাড়বে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জের কারণে পরবর্তীতে সেটি আর সম্ভব হয়নি। রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মাকে কয়েক বছর ধরে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া গ্রুপের সব কোম্পানির পারফরম্যান্সও সবসময় এক রকম থাকে না। কোনোটির ক্ষেত্রে উন্নতি হলে দেখা যায় আরেকটির অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়েই মূল কোম্পানির মুনাফায় ছন্দপতন হয়েছে। তবে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, কোম্পানির সার্বিক উন্নতির জন্য ম্যানেজমেন্ট আন্তরিক চেষ্টা করে যাচ্ছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোয় এর প্রতিফলন দেখা যাবে।

সামিট গ্রুপ : দেশের আরেক শিল্পগোষ্ঠী সামিট গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ২০১২ সালে গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান ওশান কনটেইনার লিমিটেডকে একীভূত করে। ২০১১ হিসাব বছরে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের ইপিএস ছিল ১ টাকা ৪৪ পয়সা। তবে ২০১২ হিসাব বছরে এর ইপিএস কমে ১ টাকা ৩৫ পয়সায় দাঁড়ায়।

২০১৩ হিসাব বছরে ৮৮ পয়সা, ২০১৪ হিসাব বছরে ৮২ পয়সা, ২০১৫ হিসাব বছরে ৮৭ পয়সা এবং সর্বশেষ ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৬৭ পয়সায়। ব্যবসার সমান্তরালে ইপিএস বাড়িয়ে এখনো শেয়ারহোল্ডারদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি একীভূত সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট।

কেয়া গ্রুপ : ২০১০ সালের নভেম্বরে আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী কেয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেয়া কসমেটিকসের সঙ্গে কেয়া সোপ কেমিক্যালস ও কেয়া ডিটারজেন্টকে একীভূত করা হয়। একীভূত হওয়ার আগে কেয়া কসমেটিকসের ইপিএস ছিল ৫ টাকা ২৬ পয়সা। একীভূত হওয়ার পর পরই কেয়া কসমেটিকসের ইপিএসে অধোগতির শুরু। ২০১৪ সালে কেয়া কসমেটিকসের সঙ্গে আবারো একীভূত করা হয় গ্রুপটির বস্ত্র খাতের তিন কোম্পানি কেয়া নিট কম্পোজিট, কেয়া কটন মিলস ও কেয়া স্পিনিং মিলসকে।

২০১০-১১ হিসাব বছরে কেয়া কসমেটিকসের ইপিএস ছিল ৪ টাকা ৩৯ পয়সা, যা ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১১-১২ হিসাব বছরে ১ টাকা ৭৯ পয়সা, ২০১২-১৩ হিসাব বছরে ১ টাকা ৫৫ পয়সা, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে ১ টাকা ৫১ পয়সা ও ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ২৯ পয়সায় নেমে আসে। এরপর ইপিএস বাড়তে শুরু করলেও একীভূতকরণ-পূর্ব কেয়া কসমেটিকসের স্তরে আর উন্নীত হয়নি। ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে একীভূত কেয়ার ইপিএস হয় ১ টাকা ৮৭ পয়সা ও সর্বশেষ ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে তা দাঁড়ায় ২ টাকা ১ পয়সায়।

কেয়া কসমেটিকসের কোম্পানি সচিব নূর হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, একীভূতকরণের কারণে শেয়ার সংখ্যা বাড়ায় ইপিএস কমেছে। তাছাড়া স্টক লভ্যাংশও ইপিএস কমার আরেকটি কারণ। তবে ইপিএস কমলেও কোম্পানির বিক্রি ও নিট মুনাফা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

২০১১ সালে একই গ্রুপের ভিন্ন দুই প্রতিষ্ঠান মুন্নু জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও মুন্নু প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংকে একীভূত করে মুন্নু সিরামিকস। এর পর থেকেই কোম্পানিটির মুনাফা কমতে থাকে। ২০১১-১২ হিসাব বছরে যেখানে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ৭১ পয়সা, ২০১২-১৩ হিসাব বছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩৫ পয়সায়। তাছাড়া ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে ১১ পয়সা, ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ১১ পয়সা, ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৯ পয়সা ও সর্বশেষ ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ১১ পয়সায় দাঁড়িয়েছে ইপিএস।

জানতে চাইলে মুন্নু সিরামিকসের পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মোহাম্মদ ফয়েজ মাহফুজ উল্লাহ বলেন, মূলত গ্যাসের অভাবে আমাদের উত্পাদন ব্যাহত হয়েছে। বিক্রি ও মুনাফায় এরই নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে।

বেঙ্গল গ্রুপ : তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মোপ্লাস্টিকস লিমিটেড ২০১৬ সালের শেষ দিকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বেঙ্গল পেট্রোকেম অ্যান্ড সিনথেটিক টেক্সটাইলসকে একীভূত করে। এর আগের হিসাব বছরে ইপিএস ২ টাকা ৫৪ পয়সা থাকলেও পরের হিসাব বছর ২০১৬-১৭তে তা ১ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে।

কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সর্বশেষ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে বলে জানান কোম্পানি সচিব দারুল আওয়াম তুহিন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যবসা একীভূতকরণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আলাদা মালিকানার একই খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যেই একীভূত হওয়ার প্রবণতা বেশি। আদর্শ একীভূতকরণের পর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ আর পরিচালন দক্ষতার সুফল দেখা যায় কোম্পানির মুনাফায়। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টোটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। দেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো কোম্পানি একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, এর প্রায় সবই একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির ব্যবসার ধরনও আলাদা। যদিও এক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে সিংহভাগ কোম্পানিই একীভূতকরণের সুফল দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় এর তাত্ত্বিক বিতর্কটি আরো জোরালো হয়েছে।

একীভূতকরণের পর ইপিএস কমার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ার সংখ্যার সমান্তরালে মুনাফা বাড়াতে না পারলে কোম্পানির ইপিএস কমবেই। একীভূতকরণ-পরবর্তী সময়ে ইপিএস কমলে সহজেই বলে দেয়া যায়, একীভূতকরণের সিদ্ধান্তটি কোম্পানির ব্যবসায় কোনো মূল্য সংযোজন করেনি। সিংহভাগ একীভূতকরণের পরই যখন কোম্পানির ইপিএস কমতে শুরু করে, তখন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা একীভূতকরণকে তাদের জন্য ক্ষতিকর ধরে নেবেন— এটিই স্বাভাবিক।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক প্রধান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একীভূতকরণের পর কোম্পানির ইপিএস কমে যাওয়া উচিত নয়। এতে যে উদ্দেশ্যে কোম্পানি একীভূতকরণ হলো, সেটি ব্যাহত হয়। প্রকৃতপক্ষে কী কারণে ইপিএস কমে গেছে, সেটা ভালোমতো যাচাই করে দেখা উচিত।

একীভূতকরণের পর যে দুটি কোম্পানি মুনাফায় উন্নতি করেছে, তার একটি বিদ্যুত্ খাতের প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার। ২০১৬ সালে সামিট পাওয়ারের সঙ্গে একীভূত হয় একই গ্রুপের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার, সামিট উত্তরাঞ্চল পাওয়ার ও সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার। একীভূতকরণের আগে (২০১৫ হিসাব বছরে) সামিট পাওয়ারের ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৩৬ পয়সা, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৭৬ পয়সায়। একীভূতকরণের পর ইপিএস ঊর্ধ্বমুখী থাকায় এ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে।

এছাড়া অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০০৮ সালে গ্রুপের আরেক কোম্পানি তৃপ্তি ইন্ডাস্ট্রিজকে একীভূত করে। মুনাফার ধারাবাহিকতাও ধরে রেখেছে এ প্রতিষ্ঠান। ২০১১-১২ হিসাব বছরে কোম্পানির ইপিএস ছিল ৫ টাকা ৮৭ পয়সা, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে তা বেড়ে হয় ৮ টাকা ২২ পয়সা। তথ্য সূত্র- বণিক বার্তা।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: