০৫ জানুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার, ১২:৪১ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য তিনটি সূচকের মধ্যে দুটিতে আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পাশাপাশি অর্জিত হয়েছে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকের লক্ষ্যমাত্রা। মানবসম্পদ সূচকের শর্তও এ বছরের মধ্যে পূরণ হবে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এর ফলে ২০১৮ সালের মধ্যেই এলডিসি থেকে বেরোনোর প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করবে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসতে যে তিনটি সূচক রয়েছে, তা সন্তোষজনক অবস্থায় থাকবে। এর পরের তিন বছর থাকবে পর্যবেক্ষণে। তার পরই বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনুমোদন দেবে জাতিসংঘ।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে গতকাল ‘রিবেজিং অ্যান্ড রিভিশন অব জিডিপি: বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে পরিকল্পনা বিভাগ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং যুক্তরাজ্যের আলস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এসআর ওসমানি।
এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে দ্রুতই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের অনেকগুলো মানদণ্ড অর্জন করতে পারবে জানিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবসহ নানা বাধাবিপত্তির পরও প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে মোট দেশজ উত্পাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি বিস্ময় রয়েছে— জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে বাড়ছে, মাথাপিছু আয়ের তুলনায় মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কম। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ কম হলেও অন্য দেশের তুলনায় সামাজিক সূচকে অনেক ভালো করছে। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশের এমন উন্নতি ঘটেছে, তা আমার কাছে রহস্যই। এভাবে চলতে থাকলে এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে দ্রুতই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের অনেকগুলো মানদণ্ড অর্জন করতে পারবে।
পরিকল্পনা সচিব জিয়াউল ইসলামের সভাপতিত্বে সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বেরোনোর জন্য তিনটি সূচকের মধ্যে দুটি অর্জন প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। বাকি দুটি সূচক হলো— মাথাপিছু জাতীয় আয় ও মানবসম্পদ। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৪২ ডলার হলেও এলডিসি থেকে বেরোনোর যোগ্যতা অর্জিত হবে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে বের হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০১৯ সালের মধ্যেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিনিয়োগ না বাড়িয়েও প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে উত্পাদনশীলতা বাড়াতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। উত্পাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়ানো গেলে ২০১৯ সালের মধ্যেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
জিডিপির ভিত্তিবছর পরিবর্তন প্রয়োজন উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এখন প্রযুক্তি, ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন নতুন বিষয় অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে। জিডিপির হিসাবে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া বিবিএসের উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সঠিক তথ্যের জন্য বেশকিছু জরিপ প্রতি বছর করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এবং ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু মোট জিডিপির অনুপাতে যে হারে বিনিয়োগ হচ্ছে, তাতে প্রবৃদ্ধি এত হওয়ার কথা নয়। আবার কৃষি খাতে কর্মসংস্থান এবং এ খাতের মাধ্যমে জাতীয় আয়ের অবদান নিয়ে ভাবতে হবে। জনসংখ্যা সুবিধা শুধু নম্বর দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না, মান নিয়েও ভাবতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি চারটিকে একসঙ্গে ভাবতে হবে। তরুণ শিক্ষার্থীরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে চাকরি পাচ্ছে না। দেশে অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা পাস করেও বেকার।
টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির গুণগত ও কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি মানবসম্পদের উন্নয়ন, রেমিট্যান্সপ্রবাহ ঠিক রাখা, বিনিয়োগ বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন ও মুদ্রার স্থিতিশীল বিনিময় হারের ওপর জোর দেন বক্তারা। তারা বলেন, তৈরি পোশাকের বাইরে কর্মসংস্থানের নতুন খাত সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশকে জনসংখ্যার বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। এতে জনসংখ্যার বোনাসকাল খারাপ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।
বিবিএস একটি বামন (ছোট) প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। সেমিনারে তিনি বলেন, সেখানে পরিচালক পদে কোনো পরিসংখ্যান কর্মকর্তা যেতে পারেন না। অন্য ক্যাডার থেকে পাঠানো হয়। পরিচালক পদে বিবিএসের নিজস্ব জনবল নিয়োগের জন্য আমি অনেক তদবির করেছি, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। বিবিএসকে আরো বেশি তত্পর ও সময়োপযোগী হতে হবে। বিবিএসের ত্রুটি থাকলে তা দূর করা দরকার। পরিসংখ্যানের মান উন্নত করেই উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে হিসাবের মধ্যে আনতে হবে।
দেশের কারিগরি শিক্ষায় কিছু দুর্বলতা আছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে কারিগরি শিক্ষা পিপিপি ভিত্তিতে করা যেতে পারে। শিল্পায়নের মাধ্যমে জনসংখ্যার বোনাসকাল কাজে লাগাতে হবে। ব্যাপকভিত্তিক শিল্পায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন করতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে।
বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকাল সেভাবে কাজে লাগাতে পারছে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বরকত ই খুদা। সেমিনারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকালে ঢুকেছে অনেক আগে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ মাত্র একবার এ সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সরকার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না। পোশাক খাতে যারা কাজ করছে, তারা যে খুব ভালো আছে, সেটা বলা যাবে না। তাদের মধ্যে যদি সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ত, তাহলে ভালো থাকা বোঝা যেত। সেটা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সময়ে দেশে কর্মসংস্থানের হার বাড়েনি। তবে এ সময়ে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর হার বেড়েছে। সরকার তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারছে না। দেশে বিভাগওয়ারি জিডিপি নিরূপণেরও পরামর্শ দেন তিনি।
শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।